আপনি যদি টয়লেটে বসার পর দেখেন আপনার হঠাৎ পায়খানার সাথে তাজা রক্ত যাচ্ছে তাহলে আপনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে পারেন এটাই স্বাভাবিক। তবে, হঠাৎ মলের সাথে রক্ত যাওয়া একটি গুরুতর সমস্যা সংকেত হতে পারে। যদিও সবসময় বিপদ নাও হতে পারে। মাঝে মাঝে পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়ার অনেক গুলো কারণ রয়েছে। তাই, প্রথমে আপনার থেকে কারণ গুলো খুঁজে বের করতে হবে এরপর পায়খানার সাথে রক্ত পড়া বন্ধের উপায় জানতে হবে।
মলদ্বারের দেয়ালের পর্দা ফেঁটে পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে। মলদ্বারের দেয়ালের পর্দা ফেঁটে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো কোষ্ঠকাঠিন্য। আবার অনেক সময় পায়খানার রাস্তায় ঘা হলে বা ক্ষত হয়ে গিয়ে পাতলা পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে। এছাড়া পাইলস, ক্যান্সার রক্তক্ষরণের জন্য দায়ী। যদি এসব কারণে পায়খানার সাথে তাজা রক্ত যায় তাহলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে দেখা করা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ।
সাধারণত, তিনভাবে পুরুষ বা মহিলার পায়খানার সাথে রক্ত যায়। যেমন; পায়খানার সাথে তাজা লাল, কালো রক্ত এবং অদৃশ্য হিসেবে মলের সাথে রক্ত যেতে পারে। অদৃশ্য ভাবে রক্ত গেলে সেটি বোঝা অনেক কঠিন। একমাত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সেটি বোঝা সম্ভব। তবে, লাল ও কালো রক্ত সহজে বোঝা যায় ফলে রক্তের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করলে ভালো হয়ে যায়।
তাহলে, পায়খানার সাথে রক্ত পড়া বন্ধের উপায় সম্পর্কে এই আর্টিকেল থেকে জেনে নিন। এছাড়া এই আর্টিকেলে জানতে পারবেন পায়খানার সাথে রক্ত পড়া বন্ধের ঔষধ এর নাম, পায়খানার রাস্তায় ঘা হলে করণীয়, মহিলা ও পুরুষের পায়খানার সাথে রক্ত পড়া কিসের লক্ষণ ইত্যাদি।
Table of Contents
পায়খানার সাথে রক্ত পড়া বন্ধের উপায়
পায়খানার সাথে রক্ত পড়া বন্ধের ঘরোয়া উপায় জেনে নিন:
ডাক্তারের কাছে যাওয়া
হঠাৎ পায়খানার সাথে রক্ত পড়া অথবা মাঝে মাঝে পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া এটি বিপদ বা গুরুতর সমস্যার সংকেত, তাই ডাক্তারের কাছে যাওয়া সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। মলের সাথে কয়েকভাবে রক্ত যেতে পারে। যেমন: কখনো তাজা লাল রক্ত বা কালো রক্ত, আবার অনেক সময় অদৃশ্য রক্ত যাওয়ার মতো সম্ভবনা রয়েছে। যদি এই সমস্যার পাশাপাশি বমি বমি ভাব, মাথা ঘোড়া, খারাপ লাগা ইত্যাদি অনুভব হয় তাহলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা
দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির অভাবের কারণে মল ত্যাগে সমস্যা হয়। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিত। প্রতিদিন ২ লিটার পানি পান করলে শরীরের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, শরীরের পানির চাহিদা পূরণ হবে এবং পায়খানার সাথে রক্ত পড়া বন্ধ হবে।
মলত্যাগের সময় খুব জোরে চাপ না দেওয়া
অনেক সময় পায়খানা শক্ত হলে অনেকেই খুব জোরে চাপ দিয়ে মল ত্যাগ করার চেষ্টা করে। যার কারণে মলদ্বারের মুখের চারপাশের চামড়া অনেক সময় ফেটে যায়। ফলে, পায়খানার সাথে রক্ত যায়। তবে, চামড়ার সামান্য কিছু অংশ ছিঁড়ে বলে খুব বেশি রক্তপাত হয় না এবং অনেকটা সময় রক্তের রং উজ্জল লাল হয়ে থাকে। কিন্তু, মলদ্বারের মুখের চারপাশের খুব ভেতর থেকে চামড়া ছিঁড়ে গেলে সেক্ষেত্রে পায়খানার সাথে তাজা লাল রক্ত যেতে পারে।
ধূমপান ও মদ্যপান বন্ধ করতে হবে
ধূমপান ও মদপান ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। এগুলো ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেই। ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকির কারণে পায়খানার সাথে রক্ত বের হতে পারে। বিশেষ করে ধূমপানের কারণে যদি পায়ুপথে ক্যান্সার হয় তাহলে মলদ্বারে ব্যথা হওয়া, পাতলা পায়খানার সাথে রক্ত, সকালে পায়খানার বেগ হওয়া এবং পায়খানার সাথে তাজা রক্ত যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে।
ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে
ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেলে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়, ফলে মলত্যাগে সময় কোন ধরনের সমস্যা থাকে না। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য ও পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাই যাদের মলত্যাগে সমস্যা হয় তাদের বেশি বেশি ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গুলো হলো: ডাল, ফলমূল, শাকসবজি, শিম, লাল আটা, বাদাম, মটরশুঁটি ও বিন জাতীয় খাবার। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির দিনে সর্বনিম্ন ৩০ গ্রাম ফাইবার খাওয়া উচিত।
মানসিক চাপ কমাতে হবে এবং ব্যায়াম করতে হবে
অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে। যখন আপনি অতিরিক্ত মানসিক চিন্তায় ভুগছেন তখন আপনার শরীরে হরমোন নিঃসরণ করে যা আপনার পাচনতন্ত্র কে আরো সংবেদনশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারে। তাই মানসিক চাপ কমাতে হবে এবং হাসি খুশি থাকতে হবে। যদি সম্ভব হয় প্রতিদিন সর্বনিম্ন ৩০ মিনিট থেকে ৬০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত।
মলের সাথে রক্ত যেতে দেখলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এর কারণ খুঁজে বের করবে এবং সে অনুযায়ী পায়খানার সাথে রক্ত পড়া বন্ধের ঔষধ খাওয়ার পরামর্শ দিবে। ফলে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এর পাশাপাশি উপরের উল্লেখিত কাজগুলো অবশ্যই করতে করতে হবে। আর একটি কথা মনে রাখবেন টয়লেটে বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করবেন না। যত দ্রুত সম্ভব টয়লেট থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করবেন।
আরো পড়ুন: ডিম খেলে কি প্রেসার বাড়ে?
পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়ার কারণ
মহিলা, পুরুষ ও বাচ্চাদের পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়ার কারণ সমূহ গুলো হলো:
- অ্যানাল ফিসার: পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো অ্যানাল ফিসার। পায়খানা করার সময় পায়খানা শক্ত হলে অনেকেই খুব জোরে চাপ দিয়ে মলত্যাগ করার চেষ্টা করে। এর ফলে মলদ্বারের চারপাশের চামড়া ছিঁড়ে যায়। এছাড়া, কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণেও মলদ্বারের আবরণ ছিঁড়ে যায়। মলদ্বারের এই ক্ষতকে অ্যানাল ফিসার বলা হয়।
- পাইলস: অর্শরোগ বা পাইলসের কারণে হঠাৎ মলের সাথে রক্ত যেতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় থাকলে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য রোগের ব্যক্তিদের এই ঝুঁকি বেশি থাকে। প্রথম অবস্থায় মলের সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত যেতে পারে। ধীরে ধীরে সেটি বৃদ্ধি পেতে থাকে। কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীদের এই সময় খুব বেশি সাবধানে থাকতে হবে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার চেষ্টা করতে হবে। খাবার খুব সহজে হজম হওয়ার জন্য এবং পায়খানা নরম করার জন্য নিয়মিত ফাইবার সমৃদ্ধ শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য খাবার খেতে হবে।
- কোলন ক্যান্সার: পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো কোলন ক্যান্সার বা মলাশয়ের ক্যান্সার। কোলন ক্যান্সার বা colorectal cancer কে বাংলাতে মলাশয় ক্যান্সার বলা হয়। এটি খুব কঠিন একটি রোগ। কারণ এই রোগ প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে না। পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া বা পেট ব্যথা করা কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ।
আরো অন্যান্য রোগের কারণে হঠাৎ মলের সাথে রক্ত যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই, যেই রোগ হোক না কেন যদি দেখেন পায়খানা করার সময় রক্ত বের হচ্ছে তাহলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন।
আরো পড়ুন: শ্বাসকষ্ট হলে কি কি খাওয়া যাবে না
গর্ভাবস্থায় পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া
সাধারণত, জরায়ুর চারপাশে কোলোন ও রেকটাম নামে এই অঙ্গগুলো থাকে। সন্তান যখন জরায়ুর ভেতরে স্বাভাবিক জন্ম নেই তখন এর পাশে থাকে কোলোন ও রেকটাম এই অঙ্গগুলোর উপর কিছুটা চাপ পরে। এর পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী মহিলাদের হরমোনের নানা সমস্যা হয়ে থাকে। মূলত এই সমস্যা গুলোর কারণে মাঝে মাঝে পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে এবং পায়ু পথের সমস্যাগুলো তৈরি হয়।
এই সময় পায়ুপথের সমস্যা গুলোর মধ্যে যে সমস্যা বেশি হয় সেটি হলো কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলসের কারণে এনাল ফিসার হতে পারে। গর্ভাবস্থায় এই সমস্যা গুলো না হওয়ার জন্য চিকিৎসা বিভিন্ন ঔষুধ ও খাবার দাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে। এই রোগ গুলো যদি একবার হয়ে থাকে তাহলে ভালো হতে ৩ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
ডাক্তাররা বলে খাদ্যতালিকায় ফাইবার বা আঁশজাতীয় খাবার না থাকার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। পায়খানা নরম হওয়ার জন্য এবং সাভাবিক ভাবে পায়খানা করার জন্য নিয়মিত ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবারের পাশাপাশি ঔষুধ খেতে হবে। গর্ভধারণের সময় পাইলস এবং কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায় যদি চিকিৎসা করা না হয় তাহলে স্বাভাবিকের চাইতে খুব বেশি রক্তক্ষরণ হতে পারে। আর যদি রক্তক্ষরণ হয় তাহলে বাচ্চার মায়ের সাথে সাথে বাচ্চার ও অনেক ক্ষতি হবে।
আরো পড়ুন: ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ ও প্রতিকার
পাইলসের রক্ত পড়া বন্ধের উপায়
পাইলস হলে মলত্যাগের সময় রক্ত যাওয়া স্বাভাবিক। এই সময় পায়খানার সাথে তাজা রক্ত বা উজ্জ্বল লাল বর্ণ রক্ত যেতে পারে। পাইলসের রক্ত পড়া বন্ধের জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া বাধ্যতামুলক। যদিও, পাইলসের ব্যথা খুব বেশি তীব্র হয় না। তবে, এটি ধীরে ধীরে খুব খারাপ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
অতিরিক্ত ওজন, পায়খানার বেগ আটকে রাখা, শারীরিক ভাবে পরিশ্রম না করা, পায়খানা করার সময় খুব বেশি জোরে চাপ দেওয়ার কারণে পাইলস হতে পারে। তাই এই বিষয় গুলো সচেতন থাকতে হবে। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আর বেশি হয়ে থাকে।
আরো পড়ুন: লিভার ক্যান্সার রোগীর খাবার তালিকা
পাইলসের রক্ত পড়া বন্ধের জন্য কয়েকটি কাজ করতে হবে:
- পায়ুপথ সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুকনো রাখতে হবে।
- বিছানায় শুয়ে পা উঁচু করে রাখুন এতে রক্ত চলাচল ভালো হবে এবং ব্যথা কমবে।
- মলত্যাগের পর জোরে ঘষাঘষি করা যাবে না।
- খুব জোড়ে চাপ দিয়ে পায়খানা করা যাবে না।
- আইবুপ্রোফেন ও ট্রামাডল এই ব্যথানাশক ঔষধ গুলো ব্যবহার করা যাবে না।
- বারবার পাইলস এর সমস্যা হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।
- অনবরত রক্তক্ষরণ হলে ঘরে বসে থাকা যাবে না, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
- পায়খানার রঙ কালো হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
- বেশি বেশি আঁশ বা ফাইবার যুক্ত খাবার খেতে হবে।
- নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করতে হবে।
- অতিরিক্ত ওজন হলে কমানোর চেষ্টা করতে হবে।
অনেক সময় বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যায়। যদি বন্ধ হওয়ার পর আবার কিছুদিনের মধ্যে একই সমস্যা দেখা যায় তাহলে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন। তাই সবসময় রক্তপাতের দিকে নজর রাখতে হবে।
পাইলস বা অর্শ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়ার সময় কোন ধরনের ব্যথা হয় না। মল ত্যাগ করার সময় বা মলত্যাগের পর ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়তে পারে। ব্যথা নেই বলে বসে থাকলে এটা খুবই বিপদজনক হতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্য, পাইলস ডায়রিয়া রোগীদের মশলাদার খাবার কম খাওয়া উচিত।