অর্শ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা

অর্শ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা – অর্শ রোগ অনেক সাধারণ এবং অতি পরিচিত একটি সমস্যা। অর্শ রোগ পাইলস রোগ নামেও পরিচিত। পাইলস যা হেমোরয়েডস নামেও পরিচিত। বেশির ভাগ মানুষ এই রোগটি নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পেয়ে থাকে। ফলে রোগ যখন জঠিল হয়ে যায় তখন শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, ততক্ষনে এটি খুব বড় আকারে রোগ ধারণ করে। সে কারণে অর্শ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে জানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

অনেক অর্শ রোগী ডাক্তারের সাথে পরামর্শ না করে সরাসরি হোমিওপ্যাথি ও অন্যান্য কবিরাজি ঔষুধ গ্রহণ করে থাকে। যদিও হোমিওপ্যাথি ঔষুধের মাধ্যমে অর্শ রোগ দূর করা সম্ভব, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে এটি খুব জটিল আকার ধারণ করতে পারে। কারণ, এখন পর্যন্ত অর্শ রোগের সঠিক কোন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হয় নি। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া হোমিওপ্যাথি ঔষুধ কোনো অবস্থায় গ্রহণ করা যাবে না।

আপনি যদি লজ্জার কারণে ডাক্তারের সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে না চান সেক্ষত্রে আপনার অর্শ রোগ থেকে মুক্তির উপায় হলো অর্শ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা মেনে চলা এবং জীবনযাপনের মধ্যে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। চিকিৎসা ছাড়া শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর খাবার ও নিয়মমাফিক জীবনযাপনের মাধ্যমে অর্শ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় খুব সহজে।

Table of Contents

অর্শ রোগ থেকে মুক্তির উপায়

অর্শ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বেশি বেশি ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যেমন; ফলমূল, শাকসবজি, ডাল, লাল আটার তৈরি খাবার খেতে হবে। এগুলোর সাথে বেশি বেশি পানি পান করতে হবে। এছাড়া নারকেল তেল, অ্যালো ভেরার জেল মলদ্বার উপর লাগিয়ে হালকা করে ম্যাসাজ করুন তাহলে দ্রুত সময়ের মধ্যে অর্শ রোগ ভালো হয়ে যাবে। এগুলো আপনার ব্যথা, চুলখানি ও জ্বালা কমাতে পারে।

হালকা ব্যায়াম ও গরম জল দিয়ে গোসল করার ফলে অর্শ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অর্শ বা পাইলস এর রোগ হলে সেই সময়টাতে বাথরুমে অতিরিক্ত সময় নষ্ট করা যাবে না এবং পায়খানা চাপ বেশিক্ষন আটকে রাখা যাবে না। সর্বশেষ, মলত্যাগ করার সময় খুব বেশি জোরে চাপ দিলে এই রোগ আরো জটিল হতে পারে তাই এর থেকে বিরত থাকতে হবে।

মোটামোটি উপরের উল্লেখিত কয়েকটি কাজ করলে এবং নিজের শরীরের যত্ন নিলে চিকিৎসা ছাড়া নিজে নিজে এই রোগ ভালো হয়ে যাবে। যদি, চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে, অন্যতায় রোগ বড় আকারে ধারণ করতে পারে। তাই আপনার প্রয়োজন ও অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিবেন।

অর্শ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা

নিচে অর্শ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অর্শ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই নিচের ঘরোয়া উপায় গুলো মেনে চলতে হবে।

আঁশ বা ফাইবার যুক্ত খাবার খেতে হবে

অর্শ রোগের জন্য আঁশ বা ফাইবার যুক্ত খাবারের কোন বিকল্প নেই। ফাইবার যুক্ত খাবারের তালিকায় রয়েছে সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, শুকনো ফল, ডাল, আলু, লাল আটার তৈরি খাবার, শিম, মটরশুঁটি, বিন জাতীয় খাবার ইত্যাদি। এই ধরণের খাবার অর্শ রোগের জন্য বেশি বেশি খেতে হবে।

ফাইবার বা আঁশ যুক্ত খাবার শুধু অর্শ রোগ থেকে মুক্তি দেয় না, এটি পরিপাকতন্ত্রের আরো বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রন রাখে। একজন প্রাপ্ত বয়স্কের দিনে কমপক্ষে ২৫-৩০ গ্রাম ফাইবার খাওয়া উচিত। ফলমূল ও শাকসবজি এই সব খাবারে সবচেয়ে বেশি ফাইবার থাকে।

আরো পড়ুন: আঁশ বা ফাইবার যুক্ত খাবার কোনগুলো জেনে নিন

বেশি বেশি পানি পান করুন

ফাইবার যুক্ত খাবারের পাশাপাশি বেশি বেশি পানি পান করতে হবে, কারণ ফাইবার যুক্ত খাবার পানি শোষণ করার মাধ্যমে পায়খানা নরম করে থাকে। চিকিৎসকের মতে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের দিনে কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি পান করতে হবে যা ২ লিটার পানির সমান।

ফাইবার যুক্ত খাবারের সাথে বেশি বেশি পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় এবং খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে অর্শ বা পাইলস রোগ ভালো হয়ে যাবে।

নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে

এমন কিছু ব্যায়াম আপনাকে বেছে নিতে হবে যা আপনি প্রতিদিন করতে পারেন। আপনার থেকে খুব বেশি ভারী ব্যায়াম বা জিমে গিয়ে ব্যায়াম করার প্রয়োজন নেই। আপনি চাইলে ব্যায়াম হিসেবে সাইকেল চালানো, হাঁটাচলা এইসব সাধারণ কাজ গুলো বেছে নিতে পারেন। তবে, গবেষণায় দেখা যায় অর্শ রোগের জন্য হালকা ব্যায়াম ও হাঁটা চলা অনেক কার্যকরী।

দিনে খুব বেশি হাঁটা বা ব্যায়াম করার প্রয়োজন নেই। আপনি সারাদিন ২০-৩০ মিনিট হালকা ব্যয়াম ও হাঁটলেই হবে। সেক্ষেত্রে সকাল বেলা হাঁটার উত্তম সময় হবে। চাইলে আপনি সন্ধ্যায় হাঁটতে পারেন।

বাথরুমে অযথা সময় নষ্ট করবেন না

আপনার যদি মলত্যাগ বা বাথরুম করার অবস্থায় গান গাওয়া, মোবাইল চালানো, প্রত্রিকা পড়ার অভ্যাস থাকে তাহলে সেটি বাদ দিয়ে দিন। আপনার এই অভ্যাস থাকলে অর্শ রোগের সমস্যা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।

পায়খানা বা বাথরুমের চাপ আসলে আটকে রাখা যাবে না

আপনার যদি বাথরুমের খুব বেশি চাপ আসে এরপরেও আপনি মলত্যাগ না করেন তাহলে আপনার শরীরের নানা রকম ক্ষতি হতে পারে। পাইলস বা অর্শ রোগের সমস্যা তো থাকবেই। তাই, আপনার পায়খানার চাপ আসলে বসে না থাকে বাথরুমে যেতে হবে।

মলত্যাগ করার সময় খুব বেশি জোরে চাপ দিবেন না

অনেক সময় পায়খানা খুব বেশি শক্ত হয়ে থাকে। এই সময়টাতে খুব বেশি জোরে চাপ দিয়ে মলত্যাগ করার চেষ্টা করা যাবে না। এটি অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারে। যদি আপনার এই সমস্যাটি সবসময় হয়ে থাকে তাহলে আপনি বেশি বেশি তরল জাতীয় ও শাকসবজি খাবার খান।

আরো পড়ুন: খুসখুসে বিরক্তিকর কাশি দূর করার উপায়

অ্যালোভেরার পাতা ব্যবহার করুন

অর্শ রোগের জন্য প্রাকৃতিক উপাদান সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। অ্যালোভেরার পাতা তার মধ্যে অন্যতম। অর্শ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসায় যেভাবে অ্যালোভেরার পাতা ব্যবহার করতে হবে:

  • প্রথমে একটি অ্যালোভেরা পাতা নিন।
  • এরপর, সেটি কিছুক্ষনের জন্য ফ্রিজে রেখে দিন।
  • তারপর, ব্যথা বা চুলকানি কমানোর জন্য মলদ্বারের উপর একটু একটু করে অ্যালোভেরার পাতা বা জেল প্রয়োগ করুন এবং এটি কিছুক্ষণ এভাবে ম্যাসাজ করতে থাকুন।

লেবুর রস ব্যবহার করুন

লেবুতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট চিকিৎসার মতো কাজ করে। আপনি চাইলে লেবুর রস দিয়ে সরাসরি মলদ্বারে ম্যাসাজ করতে পারেন অথবা লেবুর রসের সাথে মধু কিংবা আদা মিশিয়ে খেতে পারেন। ম্যাসাজ করার চাইতে খাওয়াটা বেশি উপকারী হবে।

বরফ ব্যবহার করুন

ব্যথা দুর করার জন্য এবং রক্ত চলাচল সচল রাখার জন্য বরফ সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। ব্যথার স্থানে বরফ লাগানোর মাধ্যমে অর্শ রোগের সমস্যা দূর করা সম্ভব। অর্শ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যেভাবে বরফ ব্যবহার করতে হবে:

  • প্রথমে, কয়েকটি বরফের টুকরো নিন।
  • এরপর, একটি সুতির কাপড়ে বরফের টুকরো গুলো পেঁচিয়ে নিন।
  • এখন, ব্যথার স্থানে বা মলদ্বারে বরফ গুলো দিয়ে ১০-১৫ মিনিট ম্যাসাজ করুন বা লাগিয়ে রাখুন।

অলিভ অয়েল লাগান

অনেকের মতে অলিভ অয়েল পাইলস বা অর্শ রোগের সবচেয়ে বড় ঔষধ হিসেবে কাজ করে। এটি ব্যথা দূর করতে সাহায্য করে। অর্শ রোগের জন্য দিনে ১ চা চামচ অলিভ অয়েল খান এবং বাথরুমে যাওয়ার আগে মলদ্বারে অলিভ অয়েল লাগান।

নারিকেল তেল ব্যবহার করুন

বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী জানা গেছে যে, নারকেল তেলে শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এর মত উপাদান থাকার কারণে এটি ব্যথা দূর করতে সাহায্য করে এবং ফোলা কমায়।

আরো পড়ুন: কি খেলে পাইলস ভালো হয় জেনে নিন

FAQ

অর্শ রোগ কেন হয়?

শরীরের অতিরিক্ত ওজন, শক্ত পায়খানা, ব্যয়াম না করা, মলত্যাগ করার সময় বাথরুমে অযথা সময় নষ্ট করা, মলত্যাগ করার সময় খুব বেশি জোরে চাপ দেওয়া এবং পায়খানার চাপ আসার পরেও মল আটকে রাখার কারণে অর্শ রোগ হয়ে থাকে। পায়ুপথে সহবাস করার কারণেও এই সমস্যা হতে পারে। এছাড়া শরীরের আরো নানা শারীরিক সমস্যার কারণে এটি হতে পারে। যেমন; গর্ভাবস্থায় নারীদের অর্শ রোগের ঝুঁকি বাড়ে।

অর্শ বা পাইলস হলে কি কি সমস্যা হয়?

পাইলস হলে মলদ্বারের চারপাশে ফুলে যাবে এবং চুলকানি হবে। এছাড়া মলদ্বারে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব হতে পারে এবং মলত্যাগ করার সময় কোন কারণ ছাড়াই রক্তপাত হবে।

অর্শ রোগ হলে কি কি খাওয়া নিষেধ?

যে সকল খাবারে ফাইবারের পরিমাণ কম থাকে সে সকল খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। এছাড়া, দোকানের তৈরি খাবার, তেলে ভাজা খাবার, মদ, অ্যালকোহল, ধূমপান, মাংস, দুধের তৈরি খাবার, পাকা কলা, অধিক লবণ যুক্ত খাবার, অতিরিক্ত ফাইবার জাতীয় খাবার অর্শ রোগ হলে খাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাবার খাওয়া উত্তম।

অর্শ রোগ হলে কি পানি খাওয়া উচিত?

অবশ্যই, অর্শ বা পাইলসে আক্রান্ত রোগীদের বেশি বেশি পানি পান করা উচিত। দিনে কমপক্ষে ২ লিটার পানি পান করা উচিত। পানির সাথে ফাইবার জাতীয় খাবার খেতে হবে। তাহলে পেট হজম সঠিক ভাবে হবে। পানি মল নরম করতে সাহায্য করে।

অর্শ রোগ হলে কোন ধরনের ঔষধ ব্যবহার করা যাবে না?

অর্শ রোগ হলে আইবুপ্রোফেন এবং ট্রামাডল এই সব ব্যথানাশক ঔষধ ব্যবহার করা যাবে না। শুধু তাই নয় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই কোন ঔষধ সেবন করা যাবে না। এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া, শরীরের আরো নানা সমস্যা তৈরি করে।

অর্শ রোগ হলে কি মানুষ মারা যায়?

সাধারণত বেশির ভাগ সময় হোমিও ঔষধ অথবা চিকিৎসার মাধ্যমে অর্শ রোগ ভালো হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে অপারেশনের মাধ্যমে ও এই রোগ থেকে বেঁচে যাওয়া সম্ভব হয়।

অর্শ রোগীদের অপারেশন করতে কত টাকা খরচ হয়?

ঢাকাতে অর্শ রোগীদের অপারেশন করতে ৪৫ হাজার টাকা থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে থাকে। তবে, এটি রোগী এবং প্রতিষ্ঠানের উপর ভিন্ন হতে পারে।

শেষ কথা

সত্য কথা হলো, অর্শ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা গ্রহন করা উচিত। চিকিৎসার পাশাপাশি অর্শ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা গুলো মেনে চলতে হবে। এই দুটি কাজ একসাথে করলে অর্শ রোগ খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ভালো হয়ে যাবে। ইনজেকশন বা ওষুধের মাধ্যমেও যদি পাইলস বা অর্শ রোগ ভালো না হয় তাহলে সর্বশেষে অপারেশন ও সার্জারির মাধ্যমে এটি ভালো করতে হবে।

সবশেষে আপনাকে যে কাজটি করতে হবে সেটি হলো অর্শ রোগে লজ্জা পাওয়া যাবে না। লজ্জা পেলে আপনি বিপদে পড়তে পারেন। আপনার সমস্যা ডাক্তারকে সম্পূর্ন পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করুন। আশা করি এই আর্টিকেল থেকে আপনি অর্শ রোগ থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!