ডিম খেলে কি প্রেসার বাড়ে

অনেকেই মনে করে ডিম খেলে প্রেসার বাড়ে। আসলেই ডিম খেলে কি প্রেসার বাড়ে, ডিম রক্তচাপ বাড়ায় নাকি ডিম উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। চিকিৎসকরা এই বিষয়ে কি বলে এই বিষয়টি “ডিম খেলে কি প্রেসার বাড়ে” এই আর্টিকেল থেকে জেনে নিন।

আমাদের শরীরের ভালো স্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন ১ টি করে ডিম খাওয়া উচিত। ৩৫ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত একজন সুস্থ মানুষ প্রতিদিন ১টি করে ডিম খেতে পারেন। তবে, কুসুম ছাড়া দিনে ২ থেকে ৩টি ডিমের সাদা অংশ খাওয়া যাবে। ৪০ বছরের উপর বয়সীদের ডিম খাওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তাদের সপ্তাহে ৩-৪ দিন ডিমের সাদা অংশ বাকি ৩-৪ দিন ডিমের কুসুম খাওয়া উচিত। তবে, ডিমের সাদা অংশ সবার জন্য নিরাপদ। ডিমের সাদা অংশে প্রোটিন থাকে এবং এতে ক্যালরি ও চর্বি কম থাকে।

যাইহোক, তাই বলে কি আমাদের ডিম খাওয়া উচিত। ডিম খেলে কি প্রেসার বাড়ে? নাকি ডিম খেলে কি প্রেসার কমে? চলুন চীনের এক গবেষণায় এই বিষয়ে কি বলেছে তা জেনে নি।

উচ্চ রক্তচাপ ও নিম্ন রক্তচাপ কি

হৃদপিন্ডের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ স্বাভাবিকের চাইতে বেশি হলে তাকে হাই ব্লাড প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ বলে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রক্তচাপের চেয়ে কমে গেলে তাকে লো ব্লাড প্রেসার বা নিম্ন রক্তচাপ বলে।

একজন মানুষের শরীরের স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি। যদি সেটি ১৪০/৯০ মিলিমিটার মার্কারি বা এর চাইতে বেশি হয় তাহলে সেটাকে হাই ব্লাড প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ বুঝায়। যদি ৯০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি বা তার চেয়ে কম হয় তাহলে সেটাকে লো ব্লাড প্রেসার বা নিম্ন রক্তচাপ বুঝায়।

আরো পড়ুন: কাঁচা কলার উপকারিতা ও অপকারিতা

ডিম খেলে কি প্রেসার বাড়ে

হাই প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের ধারণা ডিম খেলে প্রেসার বা রক্তচাপ বাড়ে। বর্তমানে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে ডিমের সাদা অংশ খেলে প্রেসার বা রক্তচাপ বাড়ায় না। ডিমের সাদা অংশ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ ও কমাতে সাহায্য করে। চিকিৎসকদের মতে, উচ্চ রক্তচাপ রোগীরা দিনে ১ টি করে ডিম খেতে পারে। তাই যারা সম্পূর্ণ ডিম খেতে চায় না তারা চাইলে ডিমের সাদা অংশ খেতে পারে।

আবার অনেকে মনে করে রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি হলে ডিম খাওয়া যাবে না। এই ধারণাটি ভুল। যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকে তারা কুসুম ছাড়া ডিমের সাদা অংশ খেতে পারবে। কারণ, ডিমের সাদা অংশে কোন ধরনের কোলেস্টেরল থাকে না। ফলে কোলেস্টেরল বা হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। ওজন কমানোর জন্য ডিমের সাদা অংশ আরো বেশি কার্যকরী। কারণ, সম্পূর্ণ ডিমে খুব বেশি ক্যালরি থাকে না। যদি সম্পূর্ণ ডিম থেকে কুসুম নিয়ে নেওয়া হয় তাহলে ক্যালরির পরিমাণ আরো কমে যায়। তাই যারা ওজন কমাতে চাই তারা চাইলে নিঃসন্দেহে দিনে ১টি করে ডিম খেতে পারে।

প্রয়োজনীয় ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি ও ভিটামিন ১২ পাওয়া যায় ডিমের সাদা অংশে। এছাড়া, ডিমের সাদা অংশে রয়েছে পেপটাইড নাম এক ধরনের উপাদান। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, এই রয়েছে পেপটাইড উপাদান হাই প্রেসার বা উচ্চ রত্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ডিমের সাদা অংশ মাইগ্রেনজনিত মাথা ব্যথা, বিভিন্ন ধরনের রোগ ও চোখের ছানি পড়ার মতো সমস্যা থেকে রক্ষা করে।

আরো পড়ুন: কিসমিস খেলে কি ওজন বাড়ে

হাঁসের ডিম খেলে কি প্রেসার বাড়ে

স্বাভাবিক ভাবে প্রতিদিন একটি করে হাঁসের ডিম খেলে প্রেসার বা রক্তচাপ বাড়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু, কেউ যদি নিয়মিত দিনে ২ থেকে ৩ টি বা তারও বেশি হাঁসের ডিম খায় তাহলে প্রেসার বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। চিকিৎসকদের মতে, কুসুম ছাড়া ডিমের সাদা অংশ খাওয়া উচিত। এতে ওজন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

ডাক্তার না বলা পর্যন্ত আপনি প্রতিদিন হাঁসের ডিম খেতে পারেন। হাঁসের ডিম খেলে শরীরের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, রক্তে নতুন ব্লাড সেল তৈরি হয়, ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে, চোখের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, পেশি মজবুত হয়, ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো হয় এবং হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকে। কিছু কিছু পুষ্টিবিদদের মতে দুটি হাঁসের ডিম তিনটি মুরগির ডিমের সমান হয়ে থাকে। তাই, মুরগির ডিম না খেয়ে হাসের ডিমের খাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

অনেকে প্রশ্ন করে হাঁসের হাঁসের ডিমে কি এলার্জি আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে পুষ্টিবিদরা বলে। হাঁসের ডিমে এলার্জি রয়েছে। বিশেষ করে হাসের সাদা অংশ খেলে এলার্জি সমস্যা দেখা যায়। তবে, প্রায় সব খাবারে এবং সব ধরনের ডিমে এলার্জি রয়েছে। কিন্তু, সব ধরনের খাবারে সবার এলার্জির সমস্যা হয় না। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন খাবারে এলার্জি সমস্যা করে। তাই, যাদের এলার্জির সমস্যা কম তারা হাঁসের ডিম খেতে পারবে। যদি, খাওয়ার পর এলার্জি সমস্যা করে থাকে এড়িয়ে যেতে হবে।

প্রেসার লো হলে কি খেতে হবে

১. নিম্ন রক্তচাপ বা প্রেসার লো হলে বেশি বেশ তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। যেমন; পানি, দুধ, দুধের তৈরি খাবার, স্যুপ, কফি, শরবত, ফলের রস ইত্যাদি। প্রেসার বাড়াতে দিনে ১ – ২ টি ডিম খাওয়া উচিত। কারণ, এতে রয়েছে ভিটামিন বি ১২ যা প্রেসার বাড়াতে সাহায্য করে। তবে কুসুম ছাড়া ডিমের সাদা অংশ খেলে প্রেসার বাড়ার সম্ভাবনা অনেক কম। ডিম না থাকলে এক গ্লাস গরম দুধ খেতে পারেন।

২. দ্রুত প্রেসার বাড়ানোর জন্য স্যালাইন খেতে হবে। এটি, তাৎক্ষণিক প্রেসার বাড়তে সাহায্য করে। স্যালাইনের সাথে হালকা লবন ও চিনি মিশিয়ে খাওয়া উচিত। প্রেসার লো হলে সাথে সাথে ৫০০ গ্রাম পানিতে ১ প্যাকেট স্যালাইন মিশিয়ে নিন। তারপর, এই স্যালাইন যুক্ত পানি গুলো ২ বার করে খান। প্রথমে অর্ধেক খাওয়ার পর বাকি অর্ধেক ২ ঘণ্টা পর খেতে হবে। ডাবের পানিও তাৎক্ষণিক প্রেসার বাড়তে সাহায্য করে।

৩. ভিটামিন সি, বি ১২, আয়রন, ফলেট এই খাদ্য উপাদান গুলো প্রেসার বা রক্তচাপ বাড়াতে সাহায্য করে। যে সকল খাদ্যে এসব উপাদান রয়েছে সেগুলো বেশি বেশি করে খান। আয়রন সমৃদ্ধ খাবার (পালং শাক, ডাল, সিদ্ধ আলু, কলিজা, ডার্ক চকলেট ইত্যাদি), ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার (টক জাতীয় খাবার, পেয়ারা, আলু, পাকা পেঁপে, লেবু, শাক, আনারস, কমলা ইত্যাদি), ভিটামিন বি ১২ সমৃদ্ধ খাবার (ডিম, মাংস, মাছ, দুধ, দুধের তৈরি খাবার, সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল, বাদাম, নুডলস, সয়াবিন ইত্যাদি)।

আশা করি আপনার প্রেসার লো হলে আপনি উপরের এই খাবার গুলো খাবেন। হঠাৎ পেশার কমে গেলে ঘরোয়া উপায়ে তাৎক্ষণিক প্রেসার বা রক্তচাপ বাড়ানোর জন্য খাবার গুলো অবশ্যই খেতে হবে। যদি এরপরেও রক্তচাপ না বাড়ে তাহলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

লো প্রেসার বা নিম্ন রক্তচাপের কারণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্ত ও পানিশূন্যতা, অতিরিক্ত পরিশ্রম, অপুষ্টি, স্বাস্থ্যকর খাবার না খাওয়া, খাবার কম খাওয়া, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, হরমোনের সমস্যা ও বয়স অনুযায়ী ওজন কম হওয়ার কারণে প্রেসার লো বা রক্তচাপ কমে যায়। নানাবিধ ওষুধের ব্যবহার কারণেও রক্তচাপ কমতে পারে।

যাদের প্রেশার বা রক্তচাপ হঠাৎ করে কমে যায় তাদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন; জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া অর্থাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, ক্লান্তি, মাথা ঘোরানো, শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অসুবিধা বুক ধড়পড় করা ইত্যাদি।

কি কি খাবার খেলে প্রেসার বাড়ে

লবণাক্ত খাবার, চিনিযুক্ত খাবার, পানি, দুধ, দুধের তৈরি খাবার, স্যুপ, ডিম, স্যালাইন, আঙ্গুর, ভিটামিন সি, বি ১২, আয়রন, ফলেট জাতীয় খাবার খেলে প্রেসার বাড়ে। তাৎক্ষণিক প্রেসার বাড়ানোর জন্য স্যালাইন, টক জাতীয় খাবার, আঙ্গুর ইত্যাদি অনেক বেশি কার্যকরী। এছাড়া, বিভিন্ন ধরনের মাছ, ফলমূল ও পরিষ্কার শাকসবজি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

আরো পড়ুন: কিডনি পরিষ্কার করে এই ৯ খাবার

হাই প্রেসার হলে কি করা উচিত

হাই প্রেসার হলে বা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পটাশিয়াম অনেক উপকারী। পটাশিয়াম যুক্ত খাবার যেমন; দুধ, দুধের তৈরি খাবার, সবুজ শাক, বিনস, বাদাম, শুকনো ফল, কাজু বাদাম, মুরগির মাংস, মাছ ইত্যাদি খেলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রতিদিন নিয়মিত ১ কাপ দুধ খেলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো খাদ্যভাস ঠিক রাখা এবং প্রতিদিন সর্বনিম্ন ৩০ মিনিট হালকা ব্যায়াম করা। লবণের কারণে প্রেসার বাড়ে তাই অতিরিক্ত লবন খাওয়া বন্ধ করতে হবে। তরকারি রান্না করার সময় খাবারে লবণ কম দিতে হবে।

ধূমপান, মদ্যপান, প্যাকেটজাত খাবার, অতিরিক্ত ভাত উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী। তাই আজকে থেকে এই সকল খাবার বাদ দিতে হবে। তবে, ভাত অতিরিক্ত না খেলে হবে। এছাড়া, চর্বি বা ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়া হবে না। যেসকল খাবারে চর্বি রয়েছে সে সকল খাবার কম খেতে হবে।

খেজুর খেলে কি প্রেসার বাড়ে

খেজুর প্রেসার বাড়ায় না, বরং এটি উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। খেজুরে ভিটামিন এ, আয়রন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি থাকার কারণে এটি রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া খেজুরে থাকা সকল উপাদান আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের এটি সাবধানে খাওয়া উচিত।

কলা খেলে কি প্রেসার বাড়ে

কলা খেলে প্রেসার বাড়ে না। কলা পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার। যা সোডিয়ামের প্রভাবকে কমিয়ে রক্তচাপ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে। এছাড়াও, কলা আমাদের শরীরের অনেক উপকার করে। হৃদরোগের ঝুঁকি ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন রাখার জন্য প্রতিদিন কলা খাওয়া উচিত।

গরুর মাংস খেলে কি প্রেসার বাড়ে

গরুর মাংস খেলে প্রেসার বাড়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। কারণ, গরুর মাংসে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি তাই পুষ্টিবিদ জাহানারা আক্তার সুমি বলেন মাংস রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই মাংস খাওয়ার সময় সাবধানে খেতে হবে। বিশেষ করে যাদের ওজন বেশি ও হার্টের সমস্যা রয়েছে তাদের সতর্কতার সাথে গরুর মাংস খেতে হবে। মাংস রান্না করার সময় তেল কমিয়ে রান্না করতে হবে।

দিনে সর্বনিম্ন ১ বার বেশি হলে সর্বোচ্চ ২ বার মাংস খাওয়া যেতে পারে এবং সেটি ৮৫ গ্রামের বেশি হতে পারবে না। তবে এর বেশি মাংস না খাওয়া ভালো। একটানা তিন দিনের বেশি গরুর মাংস না খাওয়া ভালো। মাংস রান্না করার আগে অতিরিক্ত চর্বি বের করে ফেলার চেষ্টা করতে হবে। যাদের এলার্জির সমস্যা রয়েছে তাদের গরুর মাংস না খাওয়া উত্তম।

শেষ কথা

আশা করি বুঝতে পেরেছেন ডিম খেলে প্রেসার বাড়ে না বরং প্রেসার বা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখে। তবে, অতিরিক্ত ডিম খেলে তা বিপরীত হতে পারে। তাই দিনে একটির বেশি ডিম না খাওয়া ভালো। এছাড়া ডিমের হলুদ অংশ বা কুসুমের চাইতে সাদা অংশ খাওয়া উচিত। উচ্চ রক্তচাপের জন্য ডিমের সাদা অংশ অনেক কার্যকরী।

Leave a Comment

error: Content is protected !!