পিরিয়ডের সময় প্রতিটি নারী বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। এই সময়টাতে অনেক রক্ত বের হয় যা নারীদের জন্য অনেক কষ্টকর। এছাড়া পেট ব্যাথা, মেজাজের পরিবর্তন, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, ক্লান্তি, মাথা ব্যাথা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাবার এই সময় মহিলাদের কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। যে কারণে, মহিলাদের ডায়েটের দিকে নজর দেওয়া উচিত। তাই, এই আর্টিকেলে আলোচনা করা হয়েছে পিরিয়ডের সময় কি কি খাওয়া যাবে না এবং পিরিয়ডের সময় কি কি খাবার খাওয়া উচিত ইত্যাদি।
কিছু কিছু খাবার রয়েছে যা পিরিয়ডের সময় মহিলাদের সমস্যা আরো বাড়িয়ে দেয়। আবার কিছু খাবার পিরিয়ড বা মাসিকের সমস্যা গুলো কমাতে সাহায্য করে। তাই, যাদের বয়স ১০-১৬ বছরের উপরে তাদের এই আর্টিকেলটা মনোযোগ সহকারে দেখা উচিত। এখানে পিরিয়ডের সময় কি কি খাওয়া যাবে না সেই সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া, এই আর্টিকেলে পিরিয়ড কতদিন থাকে, পিরিয়ড হলে কি কি সমস্যা হয়, ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
পিরিয়ডের সময় কি কি খাওয়া যাবে না
পিরিয়ডের সময় লবণাক্ত ও চিনিযুক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার, দুগ্ধজাত খাবার, অতিরিক্ত তেল-মশলাদার খাবার, লাল মাংস, শসা, চা ও কপি এবং কোমল পানীয় এই সকল খাবার খাওয়া যাবে না। এগুলো পিরিয়ডের সময় মহিলাদের শরীরের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা তৈরি করে। তাই পিরিয়ডের সময় উল্লেখিত এই সকল খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
পিরিয়ডের সময় এই সকল খাবার খেলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে, অস্বস্তি বাড়বে, হরমোনের পরিবর্তন হবে, বুক ধড়ফড় করবে, সামান্য ওজন বাড়বে, পেট ব্যথা হবে, বমি বমি ভাব হবে এবং বদ হজম বেড়ে যাবে। এছাড়া আরো অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে। তাই চিকিৎসকরা পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত (লবন, চিনি, চর্বিযুক্ত, তেল-মশলাদার খাবার), চা,কপি, লাল মাংস, কোমল পানীয় এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়।
পিরিয়ডের সময় যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে
পিরিয়ডের সময় কি কি খাওয়া যাবে না এক নজরে দেখে নিন:
দুধজাতীয় খাবার
পিরিয়ডের সময় দুধজাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে পেট ব্যথা, বদ হজম এবং পেটে অস্বস্তি বেড়ে যায়। তাই মাসিকের সময় দিন গুলোতে দুধ এবং দুধের তৈরি খাবার (আইসক্রিম, চিজ) এড়িয়ে চলা উচিত।
চর্বিযুক্ত খাবার
পিরিয়ডের সময় চর্বি বা তেলযুক্ত খাবার না খাওয়া উত্তম। চর্বিযুক্ত খাবার অস্বস্তি বাড়িয়ে দেই। এছাড়া, পিরিয়ডের সময় শরীরের ওজন হালকা বেশি হয় এবং হরমোনের পরিবর্তন হয়। তাই চর্বি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
লবনযুক্ত খাবার
পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত লবন খাওয়া যাবে না। এই সময় অতিরিক্ত লবন পেট ব্যথা, পেট ফাঁপা, ডিহাইড্রেশন ইত্যাদি বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই, লবণ খেতে হবে পরিমাণ মতো।
অতিরিক্ত তেল-মশলাদার খাবার
পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত তেল-মশলাযুক্ত খাবার খেলে বুক ধড়ফড় করা, পেট ব্যথা করা এবং শরীরে আরো নানা রকম সমস্যা হতে পারে। তাই এই ধরনের খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
প্রক্রিয়াজাত খাবার
সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবারে লবণ, চিনি এবং চর্বির পরিমাণ কতটুকু থাকে সেটা বলা মুশকিল। তাই প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা উত্তম।
চা ও কফি
ঘুমের সমস্যার কারণ গুলোর মধ্যে চা ও কপি অন্যতম। এছাড়া, পিরিয়ডের সময় চা ও কফি খাওয়ার ফলে পেট ব্যথা, বুক ধড়পড়, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি বৃদ্ধি পেতে পারে।
আরো পড়ুন: পাতলা চুলের জন্য শ্যাম্পু।
শসা
শসাতে থাকা বেশ কিছু উপাদান পিরিয়ডের সময় শারীরিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই, এই সময়টাতে শসা এড়িয়ে চলা উত্তম।
মিষ্টি জাতীয় খাবার
নিয়মিত মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে বা পরিবর্তন হতে পারে। এর ফলে মন মানসিকতা খারাপ হতে পারে। তাই, পিরিয়ডের সময় মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
উপরের এই সকল খাবার পিরিয়ডের সময় খুবই ক্ষতিকারক। তবে, এর মধ্যে কিছু কিছু খাবার নিয়ন্ত্রণ রেখে খাওয়া যেতে পারে। যেমন; চা বা চিনিযুক্ত খাবারে চিনির পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে, রান্না করা খাবারে লবনের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। আশা করি আপনি জানতে পেরেছেন পিরিয়ডের সময় কি কি খাওয়া যাবে না। এছাড়া, খাবারের পাশাপাশি হালকা নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে। ঘুমের অভাবে পিরিয়ডের সমস্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আর পড়ূনঃ কি খেলে পাইলস ভালো হয় জেনে নিন।
পিরিয়ডের সময় কি কি খাবার খাওয়া উচিত
পিরিয়ডের সময় পানি, সবুজ শাকসবজি, কলা, আদা, হলুদ, ব্রকলি, চর্বিহীন প্রোটিন, বাদাম, কমলা, কালো চকলেট, ফলমূল, কলা, ইত্যাদি খাওয়া উচিত। এই সকল খাবারে রয়েছে বিশেষ পুষ্টি যা পিরিয়ডের সময় শারীরিক সমস্যা গুলো থেকে রক্ষা করে।
- সবুজ শাকসবজি: পিরিয়ডের সময় সবুজ শাকসবজির উপকারীতা অনেক। এই সময় মহিলাদের ফাইবার জাতীয় খাবার খাওয়া অত্যন্ত গুরত্বপূর্ন। কারণ এই সকল খাবার দেহের হজম শক্তি উন্নত করে। সবুজ শাকসবজিতে ভিটামিন, আয়রন এবং উচ্চমাত্রায় ফাইবার পাওয়া যায়। এছাড়াও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন খাবারের তালিকায় সবুজ সবজি রাখা উচিত। বিশেষ করে পালং শাক, কচুশাক, পুঁইশাক, ডাটাশাক শরীরের জন্য অনেক উপকারী। তাই সপ্তাহে ২ বার হলেও পালং শাক খাওয়া উচিত।
- পানি: পানি সবসময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ন একটি খাবার। বিশেষ করে পিরিয়ডের সময় রক্ত বের হয় এর পাশাপাশি পানি ও বের হয়। তাই পিরিয়ডের সময় ফোলা ভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং পানি ধরে রাখার জন্য প্রতিদিন ৭-৮ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
- ফলমূল: পিরিয়ডে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি খাওয়া উচিত। আর প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি বিভিন্ন ফলমূলে পাওয়া যায় যেমন: লেবু, জলপাই, পেয়ারা, পাকা টমেটো, আমড়া, জাম্বুরা, আমলকী। তাই বেশি বেশি ফলমূল খাওয়া উচিত।
- মাছ: পিরিয়ডের সময় ব্যথা কমানোর জন্য এবং শরীরের ক্ষয় পূরণের জন্য মাছ খাওয়া উচিত। বিভিন্ন ধরনের মাছে রয়েছে ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং মিনারেল ইত্যাদি। সে কারণে পিরিয়ডের সময় ফোঁপা, ইলিশ, রূপচাঁদা, কোরাল, লইট্টা, বেলে, চিংড়ি, লেইখ্যা ইত্যাদি মাছ খাওয়া উচিত। সামুদ্রিক মাছ সবচেয়ে বেশি ভালো।
- চর্বিহীন প্রোটিন: চর্বিযুক্ত খাবার পেট ব্যথা এবং অস্বস্তি বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই, পিরিয়ডের সময় চর্বিহীন প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত।
- কলা: এতে রয়েছে উচ্চ পটাশিয়াম ও ভিটামিন যা ফোলা ভাব এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখে। এছাড়া ম্যাগনেসিয়ামের অভাব পূরণ করে।
- কালো চকলেট: এতে রয়েছে ম্যাগনেশিয়াম ও আয়রন যা আয়রনের ঘাটতি দূর করে। তাই, পিরিয়ডের সময় কালো চকলেট খাওয়া যেতে পারে।
- আদা: পেট ব্যথা এবং বমি বমি ভাব দূর করতে আদা সাহায্য করে। পিরিয়ডের সময় দুধ ও চিনি চায়ের বদলে এক কাপ আদা চা অনেক উপকারী।
আরো পড়ূনঃ মহিলাদের কোমর ব্যথার কারণ ও প্রতিকার।
FAQ
পিরিয়ডের সময় টক খেলে কি হয়?
পিরিয়ডের সময় টক খেলে মহিলাদের বিশেষ কোন ক্ষতি হয় এমন কোন ধরনের প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। তবে, পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত লবন খাওয়া ভালো না। এটি শরীরে অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
পিরিয়ডের সময় চকলেট খেলে কি হয়?
পিরিয়ডের সময় চকলেট খেলে ক্র্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে, অতিরিক্ত চিনি যুক্ত চকলেট খেলে হবে। কালো চকলেট বা কম মিষ্টি এমন চকলেট খেতে হবে। কালো চকলেট রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম যা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
পিরিয়ডের সময় কি মিলন করা যায়?
না, ইসলামের দিকে দিয়ে কুরআন-হাদীস উভয়ে পিরিয়ডের সময় মিলন করাকে নিষিদ্ধ করেছে। এই সময় স্ত্রী পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত স্বামীকে স্ত্রীর নিকট যাওয়া নিষেধ করেছে। কিন্তু, এই সময়টাতে সহবাস ব্যতীত স্ত্রীদের সাথে সব কিছু করা যাবে। স্ত্রী পবিত্রতা লাভের পর তাকে গোসল করতে হবে এরপর স্বামী ও স্ত্রী উভয় মিলন বা সহবাস করতে পারবে। চিকিৎসকদের মতে, এই সময় অসুরক্ষিত ভাবে যৌনমিলন করলে যৌনরোগের ঝুঁকি বাড়ে। তবে কেউ কেউ বলে এটা স্বাভাবিক তাই চাইলে এই সময় স্বামী স্ত্রী মিলন করতে পারে। আবার কেউ বলে এই সময় মিলন না করায় উত্তম।
পিরিয়ড হলে কি খাওয়া উচিত?
পিরিয়ড হলে সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, পানি, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার (মাছ, মাংস, ডিম), কালো চকলেট, আদা, কলা, খেজুর, তেঁতুল, আমড়া ইত্যাদি খাওয়া উচিত।
মেয়েদের পিরিয়ড হলে কি করতে হয়?
মেয়েদের পিরিয়ড হলে নিয়মিত গোসল করে পরিষ্কার থাকতে হয়, প্রচুর পানি ও পুষ্টিকর খাবার পান করতে হয়, এই সময় অতিরিক্ত ব্যায়াম করা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হয়, ৪ থেকে ৬ ঘন্টা পর পর স্যানিটারি প্যাড বদলাতে হবে।
পিরিয়ডের সময় ডিম খেলে কি হয়?
পিরিয়ডের সময় ডিম খেলে আপনার মাসিকের ব্যথা কমতে পারে। ডিমে প্রচুর পরিমানে পুষ্টি উপাদান রয়েছে। যেমন; ম্যাগনেসিয়াম, প্রোটিন, পটাসিয়াম, ওমেগা-৩, আয়রন ইত্যাদি। ডিম হাড়কে মজবুত রাখতে সাহায্য করে।
পিরিয়ডের সময় মশলাদার খাবার খেলে কি হয়?
কেউ কেউ বলে এই সময় মসলা যুক্ত খাবার খেলে পিরিয়ডের ব্যথার বিরুদ্ধে লড়াই করে। আবার কেউ কেউ পিরিয়ডের সময় মসলা যুক্ত খাবার খাওয়ার পর বমি বমি ভাব ও ফোলা অনুভবা করে। তবে এটি চিকিৎসকরা এখনো নিশ্চিত বা অস্বীকার করতে পারে নি।
পিরিয়ডের সময় কলা খেলে কি হয়?
হ্যাঁ, আপনি পিরিয়ডের সময় কলা খেতে পারেন। এতে রয়েছে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম যা আপনার পিরিয়ড ক্র্যাম্পের তীব্রতা কমাতে পারে। এছাড়া, কলা হলো একটি ফাইবার সমৃদ্ধ খবর যা সহজে মলত্যাগ করতে সাহায্য করে।
মাসিকের সময় নুডলস খেলে কি হয়?
পিরিয়ড বা মাসিকের সময় নুডুলস না খাওয়া উত্তম। কারণ, এটি আপনার ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ ও রক্তে শর্করাই বাধা দেই।
মাসিক হলে কি কি করা যাবে না?
পিরিয়ড বা মাসিক হলে ধূমপান কর যাবে না, গোপনাঙ্গের চুল বড় করা যাবে না, প্যাড ছাড়া বিছানায় যাওয়া যাবে না, অসুরিক্ষিত সহবাস করা যাবে না, ৪ থেকে ৬ ঘন্টার বেশি একই প্যাড পড়া যাবে না, অতিরিক্ত (চিনি, লবন, কফি, চা, মসলাযুক্ত খাবার) খাওয়া যাবে না।
পিরিয়ডের সময় দুধ খেলে কি হয়?
পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত দুধ ও দুধের তৈরি খাবার খাওয়ার ফলে পিরিয়ডের ব্যথাকে তীব্র করতে পারে। দুধের তৈরি খাবার যেমন; দুধ, পনির এবং আইসক্রিমে অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিড থাকে যা আপনার পেটে ও হজমের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
শেষ কথা
পিরিয়ডের সময় সঠিক খাবার খাওয়া অনেক গুরত্বপূর্ন। খাবারের কারণে অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। পিরিয়ডের সময় সুস্থ এবং সুন্দর ভাবে জীবনযাপন করার জন্য সঠিক খাদ্য গ্রহন করার কোন বিকল্প নেই। এই সময় একটু সতর্ক হওয়া উচিত। অস্বাস্থ্যকর খাবার এই সময়টাতে বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই, আপনার পিরিয়ডের সময় কি কি খাওয়া যাবে না সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা উচিত।