আর নয় গুজব, রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে যত আতঙ্ক!!

রাসেলস ভাইপার সাপ বাংলাদেশে উলুবোড়া বা চন্দ্রবোড়া উলুবোড়া নামেও পরিচিত।বাংলাদেশে পাওয়া সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ এটি। রাসেলস ভাইপার সাপ এর কামড়ে শরীরের দংশিত অংশে বিষ ছড়িয়ে অঙ্গহানি, ক্রমাগত রক্তপাত, রক্ত জমাট বাঁধা, স্নায়ু বৈকল্য, চোখ ভারী হয়ে যাওয়া, পক্ষাঘাত, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন রকম শারীরিক উপসর্গ দেখা যেতে পারে।তবে আশ্চর্যজনকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বহু বছর আগে বাংলাদেশ থেকে এই প্রজাতির সাপ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে গত ১০ থেকে ১২ বছরে আবারও এই সাপের কামড়ের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে।এই প্রজাতির সাপ এই অঞ্চলে আবার কীভাবে ফিরে আসছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে গবেষণা চলছে।

চন্দ্রবোড়ার নাম রাসেলস ভাইপার কেন? 

চন্দ্রবোড়ার ইংরেজি নাম রাসেলস ভাইপার। আজকাল অনেকেই রাসেল ভাইপার সাপ বলছে। এটা ভুল নাম। স্যার প্যাট্রিক রাসেল আমাদের এই উপমহাদেশের সাপের শ্রেণিবিন্যাসের বা ক্যাটালগিংয়ের কাজ শুরু করেন সতেরো শতকের শেষের দিকে। বলা হয়, তিনি প্রথম কাগজে–কলমে এ অঞ্চলের অনেক সাপের পরিচিতি এবং বিশ্লেষণ করেছিলেন। তার মধ্যে রাসেলস ভাইপার সাপ বা চন্দ্রবোড়াও ছিল। তাই আঠারো শতকে সাপের চূড়ান্ত শ্রেণিবিন্যাসের সময় রাসেল সাহেবের সতীর্থ বিজ্ঞানীরা তাঁর নাম জুড়ে দেয় এই সাপটির সঙ্গে। সেই থেকে চন্দ্রবোড়া হয়ে যায় রাসেলস ভাইপার। 

কতটা মারাত্মক রাসেলস ভাইপার সাপ এর দংশন?

বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপার সাপ এর কামড় খুব সাধারণ নয়, তবে প্রতি বছর ভারতে সমস্ত সাপের কামড়ের কমপক্ষে 43% এবং শ্রীলঙ্কায় 30-40% রাসেলস ভাইপার সাপ এর কারণে হয়।সাধারণত কৃষি জমিতে থাকে বলে মানুষ অনেক সময়ই সাপের গায়ে পা দেয় বা না জেনে একে বিরক্ত করে থাকে। আর রাসেলস ভাইপার সাপ বিপন্ন বোধ করলে আচমকা আক্রমণ করে থাকে।এই রাসেলস ভাইপার সাপ এর কামড়ের কিছুক্ষণ পরই দংশিত স্থানে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। ব্যথার পাশাপাশি দংশিত স্থান দ্রুত ফুলে যায় এবং ঘণ্টা খানেকের মধ্যে দংশিত স্থানের কাছে শরীরের আরো কয়েকটি অংশ আলাদাভাবে ফুলে যায়।অবিলম্বে চিকিৎসা না করা হলে, এটি নিম্ন রক্তচাপ এবং কিডনি ব্যর্থতা সহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার 2018 সালের তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় 5.4 মিলিয়ন মানুষ সাপের দ্বারা মারা যায়, যার মধ্যে প্রতি বছর কমপক্ষে 100,000 মানুষ মারা যায়। প্রতি বছর, প্রায় 400,000 মানুষ সাপের কামড়ে আহত বা অক্ষম হয়। ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন এবং বছরে অন্তত ছয় হাজার মানুষ মারা যায়।

রাসেলস ভাইপার সাপ কতটা বিষধর?

বলা হচ্ছে, রাসেলস ভাইপার সাপ পৃথিবীর পঞ্চম বিষধর সাপ। কথাটা সঠিক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে এটা মারাত্মক প্রথম ৩০ সাপের মধ্যেও নেই। বরং রাসেলস ভাইপার সাপ এর অবস্থান আমাদের দেশের গোখরা সাপের পরে। গোখরা সাপ কামড়ালে চিকিৎসা না নিলে গড়ে ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের ক্ষেত্রে গড়ে ১৮ ঘণ্টা পর ও রাসেলস ভাইপার সাপ এর কামড়ের পর গড়ে ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পরে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোগীর অন্য কোনো অসুস্থতা না থাকলে ৭২ ঘণ্টার আগে রোগী সহজে মারা যায় না।সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা বর্ণনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

গত বছর ৩ জুলাই সোমবার সকালে পদ্মার চরে (রাজবাড়ী জেলার পাংশা সুর চরপাড় এলাকা) পাটখেতে নিড়ানি দিতে গিয়ে জাহিদুল সাপের কবলে পড়েন। তাঁকে রাসেলস ভাইপার সাপ কামড় দিলে সাপটিকে মেরে মরা সাপসহ তাকে অন্য কোথাও না নিয়ে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁর স্বজনেরা। কুষ্টিয়ার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে যান। 

অন্য ঘটনায় গত ৫ মার্চ মঙ্গলবার সকালে পদ্মায় মাছ ধরতে গিয়ে রাসেলস ভাইপার সাপ এর ছোবলের শিকার হন তারিকুল ইসলাম (বাড়ি কল্যাণপুর, শিলাইদহ ইউনিয়ন, উপজেলা কুমারখালী)। তরিকুলের ডান পায়ে রাসেলস ভাইপার সাপ কামড় দিলে তিনি তাঁর সাথিদের বিষয়টি জানাতে একটু সময় নেন। বন্ধুরা আক্রান্ত স্থানে রশি দিয়ে বেঁধে দেন। তাঁদের ধারণা ছিল, এতেই কাজ হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে স্থানীয় লোকজন তাঁকে তাঁর বাড়ি নিয়ে যান। এরপর পরিবারের লোকজন তাঁকে কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে অর্থাৎ প্রায় সাত–আট ঘণ্টা সময় পার হয়ে গেছে। পরদিন বুধবার তাঁকে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ মার্চ বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর মৃত্যু হয়। 

একই রাসেলস ভাইপার সাপ এর কামড়ের রোগী একই হাসপাতাল, দুটি ক্ষেত্রেই চিকিৎসক আর তাঁর সহকারীদের মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না। তারপরও একজন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরলেন, আরেকজনকে বাঁচানো গেল না। এখানে সময়ই একমাত্র ফ্যাক্টর ছিল। প্রথম রাসেলের ভাইপার 190 মিনিটের মধ্যে সাপটিকে কামড় দেয়। তাই সঠিক চিকিৎসা পেতে ৩ ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় লেগেছে।  পরেরজন হাসপাতাল থেকে তুলনামূলকভাবে কম দূরত্বে থেকেও সময়মতো পৌঁছাতে পারেননি। সাপে কামড়ানোর চিকিৎসায় প্রথম ১০০ মিনিট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের মধ্যে ১০টি অ্যান্টিভেনম নিতে হয়। সেটাই চ্যালেঞ্জ। একজন তরুণ চিকিৎসক তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি নিজে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ চলাকালীন অন্তত চারজন রাসেল ভাইপার কামড়ের রোগীর চিকিৎসা করেছি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং দেশের প্রখ্যাত সর্প দংশন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা.এম এ ফয়েজ মনে করেন রাসেলের ভাইপার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সময়মত সঠিক চিকিৎসা নিলে আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সাল থেকে অধ্যাপক ফয়েজ সর্প দংশনের ওপর গবেষণা করে আসছেন। তাঁর মতে, মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না কারণ মানুষ ওঝার কাছে গিয়ে অহেতুক সময় নষ্ট করে। 

রাসেলস ভাইপার সাপ কেন বেশি কামড়াচ্ছে? 

মানুষ যেমন সাপকে ভয় পায়, সাপও তেমন মানুষকে এড়িয়ে চলে। প্রায় সব সাপই মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই সরে যায়। কিন্তু রাসেলস ভাইপার সাপ খুবই অলস প্রকৃতির সাপ। অনেক সময় সে গতর খাটিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় না গিয়ে বরংকচুরিপানার সাহায্য নেয়। পানার মধ্যেই শুয়ে থাকে। সে এতটাই অলস যে মানুষ দেখে তেড়ে আসা অথবা পালানো, কোনোটিই তার স্বভাবে নেই। এমনকি বাধ্য না হলে নিজের জায়গা থেকে নড়েই না, একই জায়গাই তিন-চার দিনও পড়ে থাকে। সেই কারণেই এদের কামড়ের অধিকাংশ রেকর্ডই হলো হয় মানুষ তাকে হাত দিয়েছে অথবা আঘাত করেছে, কিংবা অজগর ভেবে ধরতে গেছে। কামড় দেওয়ার পরও সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে না। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি তাকে দেখতে পায়। কামড় দেওয়ার পর সাপটা দেখা যায় বলে রোগী বা অন্যরা নিশ্চিত হতে পারে। ফলে একজন চিকিৎসক দ্রুত সঠিক অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে পারেন। তাই ঝুঁকিও কমে যায় অনেক। এ কারণেও এটি অন্য বিষধর সাপের চেয়ে কম আতঙ্কের। 

রাসেলস ভাইপার সাপ থেকে বাঁচতে করণীয়

অধ্যাপক ফয়েজের মতে, বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে একটা টাস্কফোর্স তৈরি করে চন্দ্রবোড়ার প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা এবং জনসচেতনতা তৈরি করা দরকার। মানুষ ভীত হয়ে নির্বিচার সাপ মারছে, এটা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। কোথাও কোথাও এমনকি জনপ্রতিনিধিরা সাপ মারার জন্য নগদ অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। এটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাপ শুধু ইঁদুর খেয়ে আমাদের উপকার করে না, তার বিষও অনেক ওষুধের কাঁচামাল। হৃদ্রোগ, রক্তচাপ, স্ট্রোক নিয়ন্ত্রণকারী, এমনকি ব্যথানাশক নানা ওষুধ তৈরিতেও সাপের বিষ ব্যবহার করা হয়। 

সাপের বংশবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাকৃতিক ব্যবস্থার ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। চিল, বনবিড়াল,প্যাঁচা, শিয়াল, বানর, গুইসাপ, বেজি ইত্যাদিসহ আরও বেশ কিছু প্রাণী রক্ষার জন্য প্রচারণা চালাতে হবে। 

ভয়ঙ্কর বিষধর রাসেলস ভাইপার সাপ (চন্দ্রবোড়া, বোড়া বা উলুবোড়া) দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় নদীর স্রোতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে। তাই, সবাইকে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।

এই সাপ সাধারণত নিচুভূমির ঘাস,  ঝোপ-জঙ্গল, বন, উন্মুক্ত বন, কৃষি এলাকায় বাস করে এবং মানুষের বসতি এড়িয়ে চলে। সাপটি মেটে রঙের হওয়ায় মাটির সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে। মানুষ খেয়াল না করে সাপের খুব কাছে গেলে সাপটি বিপদ দেখে ভয়ে আক্রমণ করে।

রাসেলস ভাইপার সাপ এর কামড় এড়াতে করণীয়

  • যেসব এলাকায় রাসেলস ভাইপার সাপ দেখা গিয়েছে, সেসব এলাকায় চলাচলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন।
  • যদি আপনি একটি রাসেলস ভাইপার খুঁজে পান, এটি ধরা বা মারার চেষ্টা করবেন না।
  • লম্বা ঘাস, ঝোপঝাড় ও কৃষি জমির মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় সতর্ক থাকুন।
  • গর্তের মধ্যে হাত-পা ঢুকাবেন না।
  • ঐ সকল জায়গায় কাজ করার সময় বুট এবং লম্বা প্যান্ট পরুন। 
  • পতিত গাছ, জ্বালানি কাঠ, খড় ইত্যাদি অপসারণের সময় সতর্কতা অবলম্বন করুন।
  • রাতে চলাচলের সময় অবশ্যই টর্চ লাইট ব্যবহার করুন।
  • বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার ও আবর্জনামুক্ত রাখুন।
  • প্রয়োজনে, জাতীয় হটলাইন 333 এ কল করুন বা নিকটস্থ বন বিভাগকে রিপোর্ট করুন।

রাসেল ভাইপার সাপ এর কামড় খেলে করণীয়

  • আক্রান্ত স্থাননড়াচড়া করা যাবে না।। রাসেলস ভাইপার সাপ পায়ে দংশন করলে হাঁটা যাবে না। বাহু এবং পায়ের নড়াচড়ার কারণে পেশী সংকোচনের কারণে, বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিষক্রিয়া হতে পারে।
  • আক্রান্ত স্থান সাবান বা ভেজা কাপড় দিয়ে আলতো করে পরিষ্কার করুন।
  • আক্রান্ত স্থানে সুঁই ফোটাবেন না, কাটবেন না কিংবা কোনো রকম প্রলেপ লাগাবেন না বা অন্য কিছু প্রয়োগ করা উচিত নয়।
  • ঘড়ি, গয়না, তাবিজ, কাপড় ইত্যাদি থাকলেখুলে ফেলুন।
  • সাপে কাটলে ওঝার কাছে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
  • যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা হাসপাতালে  যান।
  • আতঙ্কিত হবেন না, রাসেলস ভাইপার সাপ এর বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেছেন, দেশে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম রয়েছে এবং সমস্ত হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম মজুদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রাসেল ভাইপারের প্রাদুর্ভাব কমাতে করণীয়

বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বন বিড়াল, মেছো বিড়াল, বেজি, গুঁইসাপ, তিলা নাগ ঈগল, সারস, মদন টাক এগুলো  সাপ রাসেলস ভাইপার সাপ খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এ সকল বন্যপ্রাণীকে নির্বিচারে হত্যার কারণে প্রকৃতিতে রাসেলস ভাইপার সাপ এর মতো বিষাক্ত প্রজাতি বেড়ে যাচ্ছে। তাই বন্যপ্রাণী দেখলেই অকারণে হত্যা ও এদের আবাসস্থল ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকুন।স্মরণ রাখা প্রয়োজন, রাসেলস ভাইপার সাপ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ৬(১) ধারা অনুযায়ী সংরক্ষিত প্রাণী। রাসেলস ভাইপার সাপ ইঁদুর খেয়ে যেমন ফসল রক্ষা করে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাসেলসহ ভাইপার সাপ এর বিষ হতে অনেক জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি হয়। সাপ মারা দণ্ডনীয় অপরাধ, সাপ মারা হতে বিরত থাকুন।পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর নির্দেশনায় বাংলাদেশ বন বিভাগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। স্থানীয়ভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও সচেতন সমাজের প্রতি অনুরোধ জানানো হলো।

রাসেলস ভাইপার সাপ কামড় দিলেই কি রোগী মারা যায়?

বাংলাদেশের বেশকিছু জেলায় রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সাপটি নিয়ে যে মাত্রায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে তা কতটা যৌক্তিক?এ বিষয়ে সাপ গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসেলস ভাইপার সাপ কামড় দিলে তার চিকিৎসা আছে। সময়মত চিকিৎসা নিতে পারলে মৃত্যু ঝুঁকি কমে আসে।

ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন বলছে, বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপার সাপ সবচেয়ে বিষধর কিংবা প্রাণঘাতী সাপ নয়। বরং সাপের কামড়ে দেশে যত মানুষ মারা যায়, তার অর্ধেকই পাতি কেউটে সাপের কামড়ে। তবে দ্রুত চিকিৎসা না করলে রাসেলস ভাইপার সাপ এর কামড়ে মৃত্যুও হতে পারে।

বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর বা বিষ নিষ্ক্রিয় করতে পারে এমন উপাদানকে অ্যান্টিভেনম বলা হয়। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন জানিয়েছেন, সারাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম (সাপ কামড়ালে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়) আছে। হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

সাপে কামড় খাওয়া রোগীর শরীরে দ্রুত অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে পারলে, অ্যান্টিভেনমের অ্যান্টিবডিগুলো বিষকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেঁচে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের অশোকা ফেলো বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মো. আবু সাইদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান সাপ বিষয়ে গবেষক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে সুপরিচিত। তারা দুইজন বাংলাদেশের সাপ ও সর্প দংশন প্রতিরোধ ও চিকিৎসা বইটির রচয়িতা। তারা বলেছেন যে, রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে যেভাবে আতঙ্কের কথা বলা হচ্ছে, সেটি নিতান্তই ভয় থেকে এবং এটি অতিরঞ্জিত।

অধ্যাপক ফরিদ আহসান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন: “অনেক মানুষ অজান্তেই ভয় ছড়ায়। সবাই সাপকে ভয় পায় এবং সাপের কামড়ে মারা যাওয়ার চিন্তা তাদের মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে । চিকিৎসা নিলে যে ভালো হয়, সেটা সবাই জানে না বলেই আতঙ্ক হয়। খুব দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলেই সমাধান অনেকটা এগিয়ে নেওয়া যায়।”

গবেষক মো. আবু সাইদ বলেন, “রাসেলস ভাইপার সাপ কামড় দিলেই রোগী মারা যায় এটিও সত্য নয়, বরং রোগী সহজে মারা যায় না। ন্যূনতম ৭২ ঘণ্টার আগে সহজে রোগী মারা যায় না। বাংলাদেশেও এই সাপে কামড়ানোর পর ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার খবর পাওয়া যায়।”

বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি ডা. মো. আবুল ফয়েজ “সাপের দংশন ও এর চিকিৎসা” নিয়ে বই লিখেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, “গোখরো সাপের দংশনের গড় ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের দংশনের গড় ১৮ ঘণ্টা পর ও রাসেলস ভাইপার সাপ এর দংশনের গড় ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সময়সীমার মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা জরুরি।”

 রাসেলস ভাইপার সাপ কামড়ালে যা করবেন না

  • ক্ষতস্থান কেটে বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না।
  • ক্ষতস্থান অতিরিক্ত শক্ত করে বাঁধবেন না।
  • বমি হলে, মুখ দিয়ে ফেনা বের হলে বা কথা বলতে কষ্ট হলে মুখ দিয়ে কিছু দিতে যাবেন না
  • সাপুড়ে বা ওঝাদের ডেকে সময় নষ্ট করবেন না।
  • কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করে বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতস্থানের মুখ বন্ধের চেষ্টা করবেন না।
  • কোনো ধরনের পাথর, লালা, পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, কাদা, গোবর, কোনো ধরনের বীজ বা ভেষজ ওষুধ প্রয়োগ করতে যাবেন না। সাপের কামড়ের নিদানে এগুলো কিছু করতে পারে না।
  • তেল, ঘি, মরিচ ইত্যাদি গৃহস্থালি দ্রব্যাদি অনেক সময় প্রয়োগ করতে দেখা যায়। এগুলো কুসংস্কার মাত্র।
  • অ্যাসপিরিন বা কোনো ব্যাথানাশক ওষুধ দেবেন না।
  • অ্যালকোহল বা এ ধরনের কোনো কিছু প্রয়োগ করবেন না।
  • এমন ক্রিয়াকলাপ এড়িয়ে চলুন যা চিকিৎসা সহায়তা চাইতে বিলম্ব করে।
  • আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না। ভুক্তভোগীকে আশ্বস্ত করুন বরং।

সাপে কাটলে যা করবেন-

রাসেলসহ ভাইপার সাপ কামড়ানোর পর ভুক্তভোগীকে রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। মূলত ভুক্তভোগীকে আশ্বস্ত করা এবং তাকে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যেই তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে—

  • শুরুতেই ভুক্তভোগীকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, সাপের কামড় দেওয়ার মানেই মৃত্যু নয়। প্রকৃতিতে থাকা অধিকাংশ সাপেরই বিষ নেই। আর যেগুলো বিষধর বলে পরিচিত, সেগুলোও সব সময় কামড়ের সাথে যথেষ্ট বিষ ঢালতে পারে না। আর বিষ যেমন আছে, তার চিকিৎসায় অ্যান্টিভেনমও আছে।
  • পায়ে কামড় দিলে বসে পড়তে হবে।
  • কামড়ের স্থান থেকে বিষ যেন শরীরের অন্য অংশে ছড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে
  • হাত বা অন্য কোনো অংশে কামড়ালে সে অংশ নড়ানো যাবে না।
  • সাপের কামড়ের পর ভুক্তভোগীকে স্থির করতে হবে। নড়াচড়া করা যাবে না। যত নড়াচড়া করবে শরীরের রক্তের সাথে ওই বিষ তত মিশে যাবে।
  • সবচেয়ে ভালো হয়, হাড় ভাঙলে যেভাবে দুপাশে সহায়ক হিসেবে কাঠ বা অন্য কিছু দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়, ঠিক সেভাবে আক্রান্ত স্থানকে মাঝে রেখে বেঁধে ফেললে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতস্থানটি অবশ্যই পরিষ্কার করে নিতে হবে। ক্ষত এবং আশেপাশের জায়গা ব্যান্ডেজ করে ফেলতে হবে।
  • চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে এই ব্যান্ডেজ কোনোভাবেই খোলা যাবে না।
  • চুড়ি, আংটি, নূপুর বা আঁটসাঁট পোশাক খুলে নিন।
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হলে মুখে কৃত্রিম শ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করুন।
  • আক্রান্ত ব্যক্তিকে কাত করে লম্বাভাবে শুইয়ে দিন।
  • সাপকে মারতে বা ধরতে সময় নষ্ট করবেন না।
  • সাপটিকে যদি মেরে ফেলা হয়, তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় সাপটিও সাথে নিন।

জেনে নিন নিম পাতার ব্যবহার, উপকারিতা ও অপকারিতা

রাসেলস ভাইপার সাপ চিনবেন যেভাবে

জোহরা মিলা জানান, রাসেল ভাইপার (Russell’s Viper) সাপটি ‘চন্দ্রবোড়া’নামেও পরিচিত। দেখতে মোটাসোটা তবে লেজ সরু হয়ে থাকে। মাথা ত্রিভুজাকার এবং ‘V’ আকৃতির সাদা রেখা আছে। সাপটির গায়ে ছোপ-ছোপ গোলাকার কালো দাগ থাকে। শরীরের পৃষ্ঠতল বাদামী এবং বৃত্তাকার বা ডিম্বাকৃতির গাঢ় চিহ্নের তিনটি লম্বা সারি রয়েছে। রাসেলস ভাইপার সাপ সাধারণত লম্বায় তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত হয়। মাথার তুলনায় ঘাড় বেশ সরু। এর গায়ের রং হালকা হলদে বাদামী। ফলে শুকনো ঘাস-পাতার মধ্যে নিজেকে সহজেই লুকিয়ে রাখতে পারে। সাধারণত মে-জুলাই মাসে হলো এর প্রজননকাল। স্ত্রী সাপ ডিম দেওয়ার পরিবর্তে সাধারণত একসাথে ৫-৫০টি বাচ্চা প্রসব করে।’

জোহরা মিলা আরো বলেন, ‘রাসেলস ভাইপার সাপ হুমকি অনুভব করলে বা আতংকিত হলে  জিহ্বা বের করে প্রচণ্ড হিসহিস শব্দ করে। সাপটি সম্পর্কে যার ধারণা নেই তিনি এটিকে অজগর ভেবেই ভুল করবেন। সাপটি সাধারণত শিকার কিংবা খাদ্যের সন্ধানে রাতে বিচরণ করে।’

জোহরা মিলা আরও বলেন, সাপের বিষ, হেমোটক্সিনের কারণে মাংস পচে যাওয়ায় আক্রান্তদের মৃত্যু হয়েছে। সাপ এড়ানোর একটি কার্যকর উপায় হল সতর্ক হওয়া। এই সাপটি বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা ও সংরক্ষণ) আইন 2012 এর অধীনে সুরক্ষিত।

তথ্য অনুযায়ী, উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতেই এ রাসেলস ভাইপার সাপ এর উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। এ প্রজাতির সাপের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি ছিল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। তবে বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় এ প্রজাতির সাপের উপস্থিতি বেড়ে গেছে। তাই এ বিষধর সাপের উপদ্রব এখনই কমানো না গেলে পরে আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করছেন সচেতনমহল।

হঠাৎ কেন রাসেলস ভাইপার সাপ এর এত বিস্তৃতি?

দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে বিশেষত পদ্মার চরাঞ্চল, নদী অববাহিকা ও বরেন্দ্র এলাকায় উঁচু-নিচু ঘাস বা ফসলের জমিতে রাসেলস ভাইপার সাপটি বেশি দেখা যায়। তবে বিগত কয়েক বছরে সাপটি দেশের নদী বিধৌত বেশ কয়েকটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

এটি ঘন বন এড়িয়ে চলে এবং সমভূমি, উপকূলীয় নিম্নভূমি এবং পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই প্রজাতিটি প্রায়ই গ্রামাঞ্চলে বসতির আশেপাশে পাওয়া যায়, যেখানে ইঁদুরের বিস্তার বেশি। অন্যান্য সাপের তুলনায় রাসেলসহ ভাইপার সাপ এর বংশবিস্তারের হারও বেশি। প্রজাতিভেদে বাংলাদেশের রাসেল ভাইপার ৬-৬৩টি বাচ্চা প্রসব করে।’

তিনি বলেন, দুই দশক আগেও রাসেল ভাইপার খুব একটা দেখা যেত না, কিন্তু গত এক দশকে এই সাপের সংখ্যা বা বিস্তার বেশ বেড়েছে।

তার ধারণা, রাসেলস ভাইপার স্থলজ সাপ হলেও অনেকক্ষেত্রে এটি বন্যার পানিতে বা কচুরি পানায় ভাসতে ভাসতে বহুপথ অতিক্রম করতে পারে। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল থেকে রাসেলসহ ভাইপার সাপটি হয়তো এভাবেই পদ্মা নদী অববাহিকার জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

তার ভাষ্য, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ঝোপঝাড়ের পরিমাণও কমে গেছে। ফলে অনেক সময় বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাবার পেয়ে ফসলের ক্ষেতের আশেপাশেই আবাস গড়েছে এই সাপ; সাথে বংশবিস্তারও করছে। কৃষকরা যেহেতু ফসলের ক্ষেতেই কাজ করেন তাই তারাই বেশি রাসেলস ভাইপার সাপ এর আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।’

‘তাছাড়া বসতবাড়ির আশপাশেও ইঁদুর ও টিকটিকি প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে রাসেল ভাইপার অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে এবং মানুষকে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আক্রমণ করে বসে’, বলেন তিনি।

সাম্প্রতিককালে কৃষিপণ্যে, বিশেষ করে ধানের ক্ষেতে রাসেলের ভাইপারের আবির্ভাব প্রসঙ্গে এই বন্যপ্রাণী গবেষক বলেন: রাসেল ভাইপারের প্রিয় খাবার ভাত, ব্যাঙ, ছোট পাখি এবং টিকটিকি। যেহেতু ফসলের ক্ষেতে ইঁদুরের উৎপাত বেশি তাই খাবারের খোঁজে সেখানে গিয়ে হাজির হয় রাসেলস ভাইপার সাপ।’

আইইউসিএনের ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী রাসেলস ভাইপার সাপ বাংলাদেশে প্রায় হুমকিগ্রস্ত প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী সাপটি রক্ষিত প্রাণী বলেও জানান এই বন্যপ্রাণী গবেষক ও বন কমকর্তা।

সঠিক ব্রা সাইজ নির্ধারণ নিয়ে চিন্তিত? তাহলে জেনে নিন সঠিক সমাধান

হঠাৎ কেন রাসেলস ভাইপার সাপ এর এত বিস্তৃতি?

দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে বিশেষত পদ্মার চরাঞ্চল, নদী অববাহিকা ও বরেন্দ্র এলাকায় উঁচু-নিচু ঘাস বা ফসলের জমিতে রাসেলস ভাইপার সাপটি বেশি দেখা যায়। তবে বিগত কয়েক বছরে সাপটি দেশের নদী বিধৌত বেশ কয়েকটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

রাসেলস ভাইপার সাপ কামড়ালে যা করবেন না

ক্ষতস্থান কেটে বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না।
ক্ষতস্থান অতিরিক্ত শক্ত করে বাঁধবেন না।
বমি হলে, মুখ দিয়ে ফেনা বের হলে বা কথা বলতে কষ্ট হলে মুখ দিয়ে কিছু দিতে যাবেন না
সাপুড়ে বা ওঝাদের ডেকে সময় নষ্ট করবেন না।
কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করে বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতস্থানের মুখ বন্ধের চেষ্টা করবেন না।
কোনো ধরনের পাথর, লালা, পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, কাদা, গোবর, কোনো ধরনের বীজ বা ভেষজ ওষুধ প্রয়োগ করতে যাবেন না। সাপের কামড়ের নিদানে এগুলো কিছু করতে পারে না।
তেল, ঘি, মরিচ ইত্যাদি গৃহস্থালি দ্রব্যাদি অনেক সময় প্রয়োগ করতে দেখা যায়। এগুলো কুসংস্কার মাত্র।
অ্যাসপিরিন বা কোনো ব্যাথানাশক ওষুধ দেবেন না।
অ্যালকোহল বা এ ধরনের কোনো কিছু প্রয়োগ করবেন না।
এমন ক্রিয়াকলাপ এড়িয়ে চলুন যা চিকিৎসা সহায়তা চাইতে বিলম্ব করে।
আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না। ভুক্তভোগীকে আশ্বস্ত করুন বরং।

চন্দ্রবোড়ার নাম রাসেলস ভাইপার কেন?

চন্দ্রবোড়ার ইংরেজি নাম রাসেলস ভাইপার। আজকাল অনেকেই রাসেল ভাইপার সাপ বলছে। এটা ভুল নাম। স্যার প্যাট্রিক রাসেল আমাদের এই উপমহাদেশের সাপের শ্রেণিবিন্যাসের বা ক্যাটালগিংয়ের কাজ শুরু করেন সতেরো শতকের শেষের দিকে। বলা হয়, তিনি প্রথম কাগজে–কলমে এ অঞ্চলের অনেক সাপের পরিচিতি এবং বিশ্লেষণ করেছিলেন।

রাসেলস ভাইপার সাপ কেন বেশি কামড়াচ্ছে? 

মানুষ যেমন সাপকে ভয় পায়, সাপও তেমন মানুষকে এড়িয়ে চলে। প্রায় সব সাপই মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই সরে যায়। কিন্তু রাসেলস ভাইপার সাপ খুবই অলস প্রকৃতির সাপ। অনেক সময় সে গতর খাটিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় না গিয়ে বরংকচুরিপানার সাহায্য নেয়। পানার মধ্যেই শুয়ে থাকে। সে এতটাই অলস যে মানুষ দেখে তেড়ে আসা অথবা পালানো, কোনোটিই তার স্বভাবে নেই

রাসেলস ভাইপার সাপ কতটা বিষধর?

বলা হচ্ছে, রাসেলস ভাইপার সাপ পৃথিবীর পঞ্চম বিষধর সাপ। কথাটা সঠিক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে এটা মারাত্মক প্রথম ৩০ সাপের মধ্যেও নেই। বরং রাসেলস ভাইপার সাপ এর অবস্থান আমাদের দেশের গোখরা সাপের পরে। গোখরা সাপ কামড়ালে চিকিৎসা না নিলে গড়ে ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের ক্ষেত্রে গড়ে ১৮ ঘণ্টা পর ও রাসেলস ভাইপার সাপ এর কামড়ের পর গড়ে ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পরে রোগীর মৃত্যু হতে পারে

রাসেলস ভাইপার সাপ তাড়িয়ে ফসল কাটার পরামর্শ

রাসেলস ভাইপার সাপ অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি সাপ। তবে এর সামনে পড়লে আতংকিত না হয়ে সাবধানতার সাথে সে স্থান থেকে সরে যাওয়াই উত্তম বলে মনে করেন জোহরা মিলা। তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে সাপটির কবল থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

তার ভাষায়, ‘মাঠে কাজ করার সময় অবশ্যই জিন্সের প্যান্ট ও গামবুট পড়তে হবে যেন বাড়তি নিরাপত্তা পাওয়া যায়। কাজ শুরুর আগে ছোট বাঁশ বা লাঠি বা অন্য কিছু দিয়ে শব্দ করতে হবে যেন, আশেপাশে রাসেল ভাইপার থাকলে তা দূরে সরে যায়। জমিতে কাজের ফাঁকেও এটি করতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চিত না হয়ে কোনোভাবেই ঝোপঝাড়, বড় ঘাস, পুরাতন ও দীর্ঘদিন পড়ে থাকা ইট-পাথরে হাত দেওয়া যাবে না’।

সর্বোপরি যেসব এলাকায় রাসেলসহ ভাইপার সাপ এর উপদ্রব রয়েছে সেসব এলাকায় চলাফেরা ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলেও মনে করেন বন কর্মকর্তা।

রাসেলস ভাইপার সম্পর্কে আরো জানুন

Leave a Comment

error: Content is protected !!