আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ত্বক পরিচর্যায় কিংবা রোগ নিরাময়ে একটি অন্যতম উপাদান হলো নিম পাতা। বলা যায়, সব জাতি, সব ধর্ম এবং সব রাজ্যের মানুষের ক্ষেত্রেই এটি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। তবে আজকে আমরা আপনাকে জানাবো নিম পাতার ব্যবহার সম্পর্কে। নিম পাতার ব্যবহার আপনার জীবনকে আরো সুন্দর করে তুলবে এবং এই অবিশ্বাস্য গাছটির কি কি ভালো গুণ এবং খারাপ গুন রয়েছে তা আপনাদের জানাবো। বলা যায় এই গাছের প্রত্যেকটি অংশেরই সমান গুরুত্ব রয়েছে। পাতা, ছাল, ফল, বীজ, ডাল, নিমগাছের প্রত্যেকটা অংশই সমান উপকারী।
নিম পাতার ব্যবহার অনেক বেশি কারণ এর রস একজিমা এবং সোরিয়াসিস এর মতন ত্বকের রোগ নিরাময়ে সহায়ক। নিম গাছের ছাল যেকোনো ধরনের ব্যথা কিংবা পেটের সমস্যায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। খাদ্যদ্রব্য হিসেবে নিম পাতার ব্যবহার ব্যাপক জনপ্রিয়। নিম গাছের ফল এবং বীজ থেকে নিম তেল তৈরি করা হয়। যা বহু কাজে ব্যবহৃত হয়। নিম গাছের ডাল মুখের স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। মূলত দাঁত মাজার ক্ষেত্রে নিম গাছের ডাল ব্যবহৃত হলে। নিম পাতার উপকারিতা হিসেবে এর ঔষধি গুণাগুণ দাঁতের মাড়ি এবং দাঁতকে সুস্থ-সবল রাখতে সহায়তা করে। নিম তেল ত্বকের সুরক্ষায় এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিম পাতার ব্যবহার ব্যাপক। বহু বছর ধরে ত্বক পরিচর্যায় এবং সৌন্দর্য রক্ষায় নিম পাতার উপকারিতা ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ এর জন্য কিংবা সার তৈরির জন্য নিম পাতার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মানব শরীরের পাশাপাশি বিভিন্ন চাষের ক্ষেত্রেও নিম পাতার ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়।
Table of Contents
নিমের পুষ্টিগত মান
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিম পাতার ব্যবহার বহুক্ষেত্রে প্রচলিত। আমাদের শরীরচর্চায় এবং ত্বক এবং চুলের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে নিমপাতা। আসুন জেনে নিন নিমপাতার ব্যবহার ও পুষ্টিগত মান সম্পর্কে-
এক কাপ নিমপাতার পুষ্টিগত মান :
এক কাপ (35 গ্রাম) নিমপাতায় থাকে-
ক্যালোরি 45 গ্রাম
প্রোটিন2.48 গ্রাম
কার্বোহাইড্রেট 8.1 গ্রাম
ফ্যাট 0.03 গ্রাম
ক্যালসিয়াম 178.5 মিলিগ্রাম
আয়রন 5.98 মিলিগ্রাম
ফাইবার 6.77 গ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম 44.45 মিলিগ্রাম
ফসফরাস 23 মিলিগ্রাম
পটাশিয়াম 88.9 মিলিগ্রাম
সোডিয়াম 25.27 মিলিগ্রাম
দৈনিক 35 গ্রাম নিমপাতা গ্রহণ করা যেতে পারে।
নিম পাতার ব্যবহার
দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পদ্ধতিতে নিম পাতার ব্যবহার করতে পারেন। স্বাস্থ্যরক্ষায় নিম পাতার ব্যবহার সরাসরি করতে পারেন। ত্বক এবং চুলের সমস্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে নিম পাতার ব্যবহার করতে পারেন। আসুন জেনে নিন কীভাবে নিমপাতার ব্যবহার করবেন।
নিম পাতার ব্যবহার ও উপকারিতা
নিম গাছের প্রত্যেকটি অংশের উপকারিতা রয়েছে। তবে মূলত এর পাতার একটি অত্যন্ত অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতা রয়েছে। বহু কঠিন রোগের চিকিৎসায় নিম পাতার ব্যবহার হয়ে থাকে। হাঁপানি, ডায়াবেটিস, হজম জনিত সমস্যার ক্ষেত্রে নিম পাতার গুঁড়ো খাওয়া হয়ে থাকে। এছাড়াও এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে। তবে জেনে নিন দৈনন্দিন জীবনে নিম পাতার ব্যবহার সম্পর্কে-
স্বাস্থ্য রক্ষায় নিম পাতার ব্যবহার-
আজই জেনে নিন, স্বাস্থ্য-সম্মন্ধীয় উপকারিতায় নিম পাতার ব্যবহার।
১) অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য :
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, নিম এর মধ্যে রয়েছে দুর্দান্ত অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য। তাই শরীর থেকে যে কোন রোগ জীবাণু কে সরাতে নিম পাতার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়াও নিম গাছের পাতায় রয়েছে অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-ভাইরাল বৈশিষ্ট্য, যার ফলে প্রায় সকল প্রকার এন্টিফাঙ্গাল ও এন্টিভাইরাল চিকিৎসায় নিম পাতার ব্যবহার ব্যাপক। এছাড়াও এটি যে কোনো ধরনের রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। গবেষণায় লক্ষ্য করা গিয়েছে, নিম পাতার নির্যাস গুলিতে এস মিটানস, ই ফ্যাকালিস এবং এস অরিয়াসের মতো উপাদানগুলি রয়েছে। তাই নিম পাতার ব্যবহার যে কোন প্রকার ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও নিম গাছের ডাল থেকে সর্বাধিক অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উপাদানগুলি পাওয়া যায়। এটি যেকোন ব্যাকটেরিয়া এবং জীবাণুকে মেরে ফেলতে সহায়তা করে। এছাড়া দাঁতের ওষুধ হিসেবেও নিম পাতার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যে কারণে নিম ডালকে দাঁতন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া গবেষণায় লক্ষ্য করা গিয়েছে যে পেয়ারা এবং নিমের অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যগুলি তুলনা করে দেখা গিয়েছে, সেখানে নিমের মধ্যে অত্যধিক গুণ রয়েছে যা খাদ্যের মধ্যেকার রোগজীবাণুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এছাড়াও নিম পাতার ব্যবহার নির্দিষ্ট অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে।
২) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নিম পাতার ব্যবহার:
অত্যধিক রক্তচাপের সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় উপাদান হল নিম পাতা। শরীরকে ভেতর থেকে পরিষ্কার করতে সহায়তা করে এবং রক্ত বিশুদ্ধ করতে নিম পাতার ব্যবহার করা হয়। নিয়মিত নিম পাতা খেলে রক্ত চলাচলের পথ প্রশস্ত হয় এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে তা নিয়ন্ত্রিত হয়। দৈনিক খালি পেটে এক কাপ জলে মধু মিশিয়ে এবং নিম পাতার রস মিশিয়ে খাওয়া গেলে এটি শরীরের রক্ত চলাচল কে ত্বরান্বিত করতে পারে। এছাড়া দৈনিক নিমপাতা ব্যবহার করতে পারলে শরীরে হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যে কারণে যারা হরমোনের সমস্যায় ভুগছেন তাদের অনেক সময় নিমপাতার গুণসম্পন্ন ঔষধ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে গবেষণা এখনও চলছে। নিম পাতার ব্যাবহার করার আগে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
৩) অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে নিম পাতার ব্যবহার:
পাতার ব্যবহার হাঁপানির চিকিৎসায় সহায়তা করে। এছাড়াও এটি কফ, জ্বর এবং কাশি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতিদিন কয়েক ফোঁটা নিম তেল পান করলে অ্যাজমা কিংবা হাঁপানির মতো সমস্যাগুলি থেকে দূরে থাকা যায়। মূলত হাঁপানি নিরাময়ে নিম তেল আয়ুর্বেদ শাস্ত্র থেকেই ব্যবহার শুরু হয়।
৪) আলসার চিকিৎসায় নিম পাতার ব্যবহার :
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যে কোন ধরনের পেটের রোগ, আলসার কিংবা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় নিম পাতার ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত নিম গাছের ছাল গুঁড়ো করে যদি দৈনিক জলে মিশিয়ে খাওয়া যায় এক্ষেত্রে পেটের আলসারের সমস্যাগুলির সমাধান হতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, নিম পাতার ব্যবহার করার ফলে আলসারের মতো সমস্যা সমাধান সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও পেটে গ্যাসের সমস্যা কিংবা গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সমাধান নিম পাতার ব্যবহার এর ফলে কমে গেছে। যার ফলে আলসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নিমের ছাল। অ্যান্টি আলসার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হওয়ায় এ ধরনের রোগের নিরাময়ের ক্ষেত্রে নিম পাতার ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
৫) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিম পাতার ব্যবহার :
রক্তে শর্করার পরিমাণ হ্রাস করতে নিম পাতার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যে কারণে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গবেষণায় লক্ষ্য করা গিয়েছে, নিম হাইপোগ্লাইসেমিক প্রভাব প্রদর্শন করতে পারে। যার ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের ব্যবহারের ফলে উপকার মেলে। এছাড়াও ডায়াবেটিস রোগের সূত্রপাত দেখা দিলে সেই রোগের জীবাণু নাশক করতে নিম পাতার ব্যবহার করা হয়। ডায়াবেটিসজনিত অক্সিডেটিভ চাপ প্রতিরোধ করতে পারে নিম। নিম গাছ গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিক গুণ প্রদর্শন করে, যার ফলে শরীরের মধ্যে যে কোন রোগ জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে এটি।
৬) মৌখিক স্বাস্থ্য রক্ষায় নিম পাতার উপকারিতা :
দাঁত এবং দাঁতের মাড়ির বিভিন্ন সমস্যার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকার হল নিম। নিম তেল দাঁতের মাড়ির যেকোনো সমস্যা সমাধান করতে পারে। নিমের নির্যাসযুক্ত মাউথ ওয়াশ মুখের স্ট্রেপটোকক্কাস মিউট্যান্সের বৃদ্ধিকে প্রশমিত করে। এই ব্যাকটেরিয়ার ফলে মুখের সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এছাড়াও তেল পরিশোধন এবং অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল এজেন্ট হিসেবে নিম তেলকে বিভিন্ন টুথপেস্টে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়াও মাঁড়ি ও দাঁতের সমস্যার ক্ষেত্রে নিম পাতার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিম পাতার নির্যাস দাঁতের যেকোনো ধরনের সমস্যা, মাড়ির সমস্যা, দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে সহায়তা করে। এছাড়া নিম গাছের ডাল দিয়ে যদি দাঁত মাজা যায় কিংবা নিম গাছের ছাল চিবানো যায় তা দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নিম, দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। যে কারণে এটি বিভিন্ন টুথপেস্টের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি দাঁত মাজার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। দাঁতের ব্যথা দূর করতে, দাঁত পরিষ্কার করার জন্য নিমের ডাল ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলি দাঁতকে চকচকে এবং সাদা করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম পাতা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি মুখের মাঁড়ি এবং দাঁতের টিস্যু গুলোর মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে, মুখের ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।
৭) কুষ্ঠ রোগ নিরাময়ে নিম পাতার ব্যবহার :
এমন একটা সময় ছিল যে সময় কুষ্ঠ রোগ হলে মানুষকে সমাজ থেকে পরিত্যক্ত করা হত। মনে করা হত, এর সঠিক চিকিৎসা নেই। যার ফলে কুষ্ঠ আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে এলে সেটি অপরজনের হয়ে যাবে। তাই সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে মানুষটিকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হত। আমাদের মধ্যে অনেকেরই জানা নেই আমাদের হাতের কাছে থাকা নিম পাতার ব্যবহার এই রোগের পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। গবেষণায় লক্ষ্য করা গেছে, নিম গাছের ফল ও বীজ থেকে তৈরি তেল কুষ্ঠ রোগের নিরাময়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। নিম মিউটেজেনিক অর্থাৎ এটি কোন ব্যক্তির ডিএনএতে কোন রকমের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। তবে নিম বীজের তেল গ্রহণের আগে একটু সাবধানে থাকুন। কেননা এটির অতিরিক্ত গ্রহণের ফলে বিষাক্ত প্রভাব সৃষ্টি হয়, যা আপনার শরীরের পক্ষে ভালো নাও হতে পারে। তাই এটি ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করুন।
৮) ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে নিম পাতার ব্যবহার :
মশার কামড়ে সৃষ্টি হওয়া ম্যালেরিয়া আমাদের অত্যন্ত পরিচিত একটি রোগ। তবে এই রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে শরীর দুর্বল হয়ে ওঠে, যার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। কিন্তু আপনি জানেন কি নিম পাতার নির্যাসে রয়েছে এক ধরনের অ্যান্টি ম্যালেরিয়াল বৈশিষ্ট্য, যা শরীরের ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করতে সহায়তা করে। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে ওষুধগুলো প্রয়োগ করা হয় সেই ওষুধ গুলির মধ্যে নিম পাতার ব্যবহার হতে পারে। ইনফিউশন ম্যালেরিয়া রোগের অন্যতম প্রতিকার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা ক্ষেত্রে অন্যতম উপাদান হিসেবে নিম পাতার ব্যবহার হয়ে থাকে।
৯) হজমে সহায়তা করে নিম পাতার ব্যবহার :
বদহজম, অম্বল, বুক জ্বালা এই সমস্যাগুলি আমাদের দৈনন্দিন সঙ্গী। তবে এ সমস্যাগুলো সমাধানে নিম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নিমের মধ্যে হজমে সহায়ককারি কিছু উপাদান রয়েছে, যা বদহজমের সমস্যাকে কমাতে এবং খাদ্য হজমে সহায়তা করে। মূলত নিমপাতার গুঁড়ো কিংবা নিমের তরল নিষ্কাশনে করে ব্যবহার করা যেতে পারে। মূলত হজমজনিত অসুস্থতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিম, বিশেষত হজম এর জন্য উপকারী। গ্যাস, অম্বল, বদহজমের মতন সমস্যাগুলিকে যদি দূরে রাখতে চান নিয়মিত নিম পাতার ব্যবহার করা দরকার। কেননা নিম পাতায় উপস্থিত ইনফ্লেমেটরি উপাদান গুলো গ্যাস্ট্রিকের এবং হজম সংক্রান্ত সমস্যাগুলির সমাধান করে থাকে। যার ফলে আলসারের মতো রোগের প্রকোপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটে এবং পেটে ফাঁপা ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা গুলো দূরে চলে যায়।
১০) লিভারের স্বাস্থ্যরক্ষায় নিম পাতার ব্যবহার :
লিভারের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে নিম গাছের ফুল গুলি। এগুলি লিভার কার্সিনোজেনেসিসে প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব ফেলে, যার ফলে লিভারের যেকোনো ধরনের সমস্যা কিংবা জন্ডিসের সমস্যা প্রভৃতি সমস্যায় নিম পাতার ব্যবহার প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব প্রদান করে থাকে।
১১) ক্যান্সার নিরাময়ে নিম পাতার ব্যবহার :
বর্তমানে ভারতে ক্যান্সার রোগের প্রকোপ যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে আমাদের মাঝে সব বয়সের মানুষদেরই নিয়মিত নিম পাতা খাওয়ার অভ্যাস করা প্রয়োজন। কেননা নিম পাতায় রয়েছে পলি স্যাকারাইডস এবং লিওমনোয়েডস নামক দুটি উপাদান যা আমাদের রক্ত থেকে ক্যান্সার এবং টিউমারেরর কোষকে ধ্বংস করতে সহায়তা করে। নিম পাতার ব্যবহার এর ফলে ক্যান্সারের জীবাণু আমাদের আশেপাশে আসতে পারে না। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, নিম পাতার নির্যাস প্রোস্টেট ক্যান্সারের কোষগুলোকে ধ্বংস করতে সহায়তা করে। এছাড়াও নিমপাতার মিশ্রন ক্যান্সার প্রসারণ রোধ করতেও সহায়তা করে। শরীরের অনাক্রম্যতা প্রতিক্রিয়া উন্নত করে, ফ্রি রেডিক্যাল গুলি নির্মূল করে কোষ বিভাজন এবং প্রদাহ জনিত সমস্যা গুলিতে বাধা দিয়ে ক্যান্সার চিকিৎসায় নিম পাতা সহায়তা করে থাকে। নিমপাতায় থাকে প্রোটিন গ্লাইকোপ্রোটিন নামক রোগ প্রতিরোধক উপাদান। যা শরীরে ক্যান্সারের জীবাণু ধ্বংস করতে এবং তার চিকিৎসা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে দেখা গিয়েছে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় নিম পাতার ব্যবহার কার্যকর হয়েছে। নিমের যৌগ গুলি কেমো থেরাপিউটিক এজেন্ট গুলির কার্যক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম রয়েছে।
১২) কোলেস্টেরল কমাতে নিম পাতার ব্যবহার :
সমীক্ষায় লক্ষ্য করা গিয়েছে, নিম পাতার ব্যবহার রক্তের কোলেস্টেরল হ্রাস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যারা কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে রোজ যদি নিমপাতার রস কিংবা জলে ফুটিয়ে নিম পাতার জল গ্রহণ করা সম্ভব হয় সে ক্ষেত্রে কোলেস্টেরল মাত্রা শরীরে কমতে লক্ষ্য করা যায়।
ত্বকের জন্য নিম পাতার ব্যবহার
হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তন হলে কিংবা খাদ্যতালিকায় একটু বেহিসাবি খাওয়া হয়ে গেল মুখে ব্রণ ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কখনও বা শরীরের অভ্যন্তরীণ অন্যান্য সমস্যার কারণেও ব্রণ, হোয়াইট হেডস, ব্ল্যাকহেডস, পিম্পল এর মতন সমস্যাগুলি লক্ষ্য করা যায়। তবে এর সমাধান কিন্তু আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে। ত্বকের যত্নে নিম পাতার ব্যবহার বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ত্বকে ব্যাকটেরিয়া জনিত সমস্যার কারণে কিংবা ব্রণ কমাতে নিম পাতার ফেসপ্যাক আমরা ব্যবহার করতে পারি কিংবা নিমপাতা দিয়ে তৈরি ঘরোয়া প্যাক ব্যবহার করতে পারি। নিম পাতার মধ্যে ভিটামিন ই প্রচুর পরিমাণে থাকার কারণে এটি ত্বককে যথার্থ আর্দ্রতা প্রদান করে থাকে। এছাড়াও নিমপাতা সিদ্ধ করে নিয়ে সেই জল প্রতিদিন ত্বকে লাগালে ত্বক সুস্থ থাকতে সহায়তা করে। এবার জেনে নিন কয়েকটি প্রাথমিক ত্বকের সমস্যার সমাধানে নিমের ভূমিকা গুলি।
১) ক্ষত এবং ফুসকুড়ি নিরাময়ে নিম পাতার ব্যবহার :
ত্বক পরিচর্যায় প্রাচীন যুগ থেকেই নিম পাতার ব্যবহার হয়ে আসছে। নিম তেলের মাধ্যমে তৈরি বিভিন্ন উপাদানগুলি দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের সমস্যাগুলির চিকিৎসা করে থাকে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, নিম এবং হলুদের মিশ্রণ ত্বকের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী রোগের লক্ষ্যণগুলি নির্মূল করে। আলসার কিংবা ত্বকের যেকোনো দাগ-এর চিকিৎসা নিম দিয়ে করা হয়ে থাকে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি সরাসরি ত্বকে ব্যবহার করা ঠিক হবে না। ত্বকের যেকোনো জীবাণুর সংক্রমণ থেকে ত্বককে রক্ষা করতে বিভিন্নভাবে নিম পাতার ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
জেনে নিন কিভাবে নিম পাতার ব্যবহার করে ফুসকুড়ি এবং ক্ষত নিরাময় করবেন :
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
১) পানি ভালো করে ফোটাতে হবে।
২) তারমধ্যে ১০-১৫ টি নিম পাতার ব্যবহার করবেন।
৩) পাতাটি বিবর্ণ হওয়া পর্যন্ত ফোটাতে থাকবেন।
৪) পানির পরিমাণ যখন অর্ধেক হয়ে আসবে তখন চুলা নিভিয়ে দেবেন।
৫) এবার এই পানি ঠান্ডা করে সংরক্ষণ করবেন।
৬) প্রতিদিন রাতে শুতে যাওয়ার আগে ঐ পানি তুলোয় ভিজিয়ে নিয়ে সারা মুখে লাগিয়ে শুয়ে পড়বেন।
৭) এছাড়াও আপনার গোসলের পানিতে কয়েক ফোঁটা নিম তেল মিশিয়ে গোসল হয়ে গেলে পানিটা সারা শরীরে ঢেলে দিন এর ফলে শরীর জীবাণুমুক্ত থাকবে।
২) ব্রণ নিরাময়ে নিমের উপকারিতা :
তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারী যারা তাদের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হল ব্রণ। তবে এক্ষেত্রে এটি নিরাময়ের জন্য হাতের কাছেই থাকা নিম পাতার ব্যবহার করা যায়। পাশাপাশি যে সমস্ত ব্রনর কারনে ব্রেকআউট ত্বকে দেখা যায় সে গুলির সমাধানেও নিম পাতার ব্যাবহার করতে পারেন। নিম পাতা এবং হলুদের পেস্ট নিয়মিত ব্যবহার করার ফলে মুখে ব্রনর দাগ কমে যেতে সহায়তা করে এবং এটি ত্বককে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং উজ্জ্বল করে তোলে। প্রয়োজনে একসাথে হলুদ ও নিম পাতার ব্যবহার করতে পারেন। এটি ত্বক উজ্জ্বল করতে সহায়তা করবে। এর পাশাপাশি নিমের মধ্যে রয়েছে অন্যতম ময়েশ্চারাইজিং বৈশিষ্ট্যসমূহ। যা ত্বককে খুব বেশি তৈলাক্ত না করে শুষ্কতা থেকে মুক্তি দেয় এবং ত্বকের ভারসাম্য রক্ষা করে। ত্বকে যেকোনো ধরনের চুলকানির ক্ষেত্রে নিম পাতার ব্যবহার করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি চোখের ডার্ক সার্কেল দেখা দিলেও সেক্ষেত্রেও নিমপাতার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। চোখের ডার্ক সার্কেল কমাতে ও নিম পাতার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ন ভূৃমিকা নিয়ে থাকে।
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
১) নিম পাতা পানিতে সিদ্ধ করে টোনার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
২) ব্রণের দাগ এবং পিগমেন্টেশন নিরাময়ের জন্য নিম পাউডার পানির সাথে মিশিয়ে ব্রণের দাগের ওপর ব্যবহার করতে পারেন।
৩) আপনার ত্বকে অতিরিক্ত ব্রণের সমস্যা থাকলে, আপনি আপনার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিম তেল ব্যবহার করতে পারেন।
৪) নিম পাতা, তুলসী এবং চন্দন কাঠের গুঁড়ো ভালো করে পেস্ট করে নিয়ে গোলাপজল দিয়ে মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। এই মিশ্রণটি মুখে লাগিয়ে ২০ মিনিট অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেলুন। এতে ব্রণর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
৫) ব্ল্যাকহেডস ও হোয়াইটহেডস এর সমস্যা থাকলে 2 থেকে 3 ফোটা নিম তেল পানির সাথে মিশিয়ে মুখে মেখে ১৫ মিনিট রেখে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
৬) নিম পাতা সিদ্ধ করে নিয়ে তারমধ্যে কমলালেবুর খোসা এবং বিট দিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে নিন কমলালেবুর খোসা এবং নরম হয়ে এলে সেটা প্যাক বানিয়ে মুখে লাগিয়ে নিন এবং অপেক্ষা করুন সমস্যার পাশাপাশি দাগ দূর হবে।এই প্যাকটি ব্রণ পরিষ্কার করতে সহায়তা করবে। ব্রণ দূর করতে নিয়মিত নিম পাতার ব্যবহার করতে পারেন।
৭) গোলাপজলে মিশিয়ে নিম পাতার ব্যবহার করে পেস্ট তৈরি করে মুখে লাগান এবং আপনার ত্বক যদি খুব শুষ্ক হয় সেক্ষেত্রে এই প্যাকটিতে সামান্য পরিমাণে মধু এবং দই যোগ করতে পারেন।
৮) এছাড়া গোসলের সময় সারা গায়ে মাখার জন্য নিম সাবান ব্যবহার করতে পারেন কিংবা নিমপাতা ভিজানো পানি স্নানের পর গায়ে ঢালতে পারেন এতে যেকোনো ধরণের ত্বকের সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
চুল পরিচর্যায় নিম পাতার ব্যবহার
নিম পাতা ত্বক ও চুলের যত্নে সমানভাবে ব্যবহার করা হয়। চুলের জন্য নিম পাতার সঠিক ব্যবহার চুলের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে এবং চুলের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারে এবং নিম পাতার মধ্যে থাকা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং ইমিউন বুস্টিং বৈশিষ্ট্যগুলি চুলকে সুস্থ রাখে এবং চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। নিম পাতা চুল পড়া কমাতে সহায়তা করে থাকে। নিম তেল দিয়ে মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করলে মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, যার ফলে চুলের বৃদ্ধির হার বেড়ে ওঠে। নিম তেলের সাথে নারকেল, জলপাই কিংবা জোজোবা তেল মিশ্রণ করে মাথায় ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও নিম পাতার পেস্ট মাথায় লাগাতে পারেন। যা চুলকে জীবাণুমুক্ত রেখে সুস্থ সবল করে তুলবে চুল। নিম যেমন শুষ্ক ত্বকে আর্দ্রতা প্রদান করে, তেমনি রুক্ষ চুলেও আর্দ্রতা প্রদান করে থাকে। এছাড়াও, চুলকে উকুন এবং খুশকির সমস্যাগুলি থেকে দূরে রাখে এবং এটি মাথার ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মূলত নিম গুড়ার সাথে শিকাকাই গুঁড়ো, পানি এবং লেবুর রস মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে শ্যাম্পু করার ৩০ মিনিট আগে চুলে ব্যবহার করুন এটি চুলের আদ্রতা ধরে রাখতে সহায়তা করবে। এছাড়াও যাদের অকালপক্কতা কিংবা টাক পড়ে যাবার মতন সমস্যা দেখা দিয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও একমাত্র সমাধান নিম। নিম চুলকে শক্তিশালী করে হারিয়ে যাওয়া চুলের পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। এছাড়াও নিয়মিত নিম পাতার ব্যবহার চুলের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে নতুন চুল গজাতেও সহায়তা করে। আসুন জেনে নিন তাহলে চুলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানে নিম পাতার ব্যবহার:
১) উকুন কমাতে নিমের ব্যবহার :
সুন্দর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল পরিষ্কার চুলের স্বপ্ন সবারই থাকে। কিন্তু উকুন এবং খুশকির মতো সমস্যাগুলি চুল সুস্থ থাকতে দেয় না। তাই চুলের সৌন্দর্য প্রদানে নিম পাতার ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম পাতার ব্যবহার চুল থেকে উকুন-এর সমস্যা দূর হয়। এর মধ্যে অত্যধিক তেতো ভাব এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
নিম পাতার পেস্ট তৈরি করে নিয়ে মাথার তালুতে ভালো করে লাগিয়ে নিন ২-৩ ঘন্টা রেখে দিন। তারপর ভালো করে শ্যাম্পু করে ফেলুন।শ্যাম্পু করার পর উকুনের চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ে নিন।সপ্তাহে দু-তিনবার করে টানা ২-৩ মাস এটি ব্যবহার করুন এর ফলে চুল থেকে পুরোপুরি ভাবে উকুন দূর হয়ে যাবে।
নারকেল তেলের সাথে নিমপাতা ভালো করে সিদ্ধ করে নিয়ে যতক্ষণ না পাতার রং বিবর্ণ হচ্ছে ততক্ষণ নারকেল তেলে ভালোভাবে ফুটিয়ে নিন। এরপর তেল ঢেলে নিয়ে ঠাণ্ডা করে মাথায় লাগিয়ে দু ঘণ্টা অপেক্ষা করুন।তারপর শ্যাম্পু করে ফেলুন এবং উকুনের চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ে নিন।সপ্তাহে তিনদিন এটি ব্যবহার করুন একমাসেই তফাৎ বুঝতে পারবেন।
২) খুশকি নিরাময়ে নিম পাতার ব্যবহার :
মাথার ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক বা তৈলাক্ত হোক না কেন, আমরা খুশকির সমস্যা অনুভব করি। এই ক্ষেত্রে নিম পাতায় অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা চুলের চিকিৎসা কার্যকর করে তোলে। এছাড়াও নিম পাতার ব্যবহার মাথার তালুর শুষ্কতা এবং চুলকানি দূর করে চুলকে সঠিক স্বাস্থ্য প্রদান করে থাকে। খুশকির চিকিৎসার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভুমিকা প্রদান করে থাকে। তাহলে জেনে নিন খুশকি নিরাময়ে কিভাবে করবেন নিম পাতার ব্যবহার করবেন-
কীভাবে ব্যবহার করবেন?
একবাটি পানিতে ১০-১২ টি নিম পাতা নিয়ে ভালো করে সিদ্ধ করে নিন। এবার জল ঠাণ্ডা করে শ্যাম্পু করার সময় এই পানি দিয়ে ভালো করে চুলে মাসাজ করে নিন। প্রতি সপ্তাহে দুদিন এটি করুন দেখবেন খুশকি দূর হয়ে যাবে।
এছাড়াও নিমপাতা ভালো করে বেটে নিয়ে মাথার চুলের গোড়ায় ভালো করে লাগিয়ে এক ঘণ্টা রেখে শ্যাম্পু করে ফেলুন। দেখবেন চুল পড়া কমবে তার পাশাপাশি খুশকির সমস্যাও দূর হবে। এর পাশাপাশি চুল নরম এবং কোমল হবে।
মধু ও নিম পাতার রস মিশিয়ে গোড়া থেকে গোড়া পর্যন্ত লাগান সপ্তাহে তিন দিন। চুল হবে ঝলমলে।
এছাড়াও আমলকির রস, লেবুর রস, নিম পাতার রস এবং টকদই মিশিয়ে সপ্তাহে দুদিন চুলে লাগিয়ে শ্যাম্পু করে নিন। এটি চুলে কন্ডিশনার-এর কাজ করবে।
দৈনন্দিন জীবনে নিম পাতার ব্যবহার
দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পদ্ধতিতে নিম পাতার ব্যবহার করতে পারেন। স্বাস্থ্যরক্ষায় নিমের ব্যবহার সরাসরি করতে পারেন। ত্বক এবং চুলের সমস্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে নিমপাতার ব্যবহার করতে পারেন। আসুন জেনে নিন কীভাবে নিমপাতার ব্যবহার করবেন।
স্বাস্থ্য রক্ষায় কিভাবে?
১) ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হজম সংক্রান্ত সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ এ ধরনের সমস্যা গুলোর ক্ষেত্রে নিম পাতার ব্যবহার ব্যাপক।
২) আপনি সকালে খালি পেটে নিম পাতা পাতার ব্যবহা পারেন বা আপনার ডায়েটে সেদ্ধ নিম পাতা অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
৩) দৈনিক নিম পাতা গ্রহণ করার ফলে শরীর জীবাণু মুক্ত থাকবে। তাই প্রতিদিন নিম গ্রহণ করতে পারেন।
৪) হাঁপানিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও প্রতিদিন কয়েক ফোঁটা নিমের তেল পান করতে পারেন।
৫) যাদের পেটের সমস্যা আছে তারা তাদের ডায়েটে নিম পাতা অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
৬) রক্তে শর্করার পরিমাণ হ্রাস করতে নিম পাতার ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীরা ও তার খাদ্যতালিকায় নিমপাতা রাখতে পারেন।
৭) নিম পাতা দাঁত ও মাড়ির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। যাইহোক, নিম পাতা আপনার শরীরের জন্য কার্যকর কিনা তা জানতে আপনার চিকিৎসার অবস্থার উপর নির্ভর করে ব্যবহার করার আগে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে ভুলবেন না।
৮) আবার ত্বক পরিচর্যার ক্ষেত্রেও নিম পাতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ত্বকের যেকোনো ধরনের সমস্যা যেমন ব্রন, ফুসকুড়ি ইত্যাদি সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে নিম পাতার ব্যবহার করা যেতে পারে।সেক্ষেত্রে নিম পাতার ব্যবহার করে ঘরে টোনার, ফেসপ্যাক তৈরি করে নিয়ে ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। এটি খুব কম সময়ের মধ্যেই আপনার ত্বককে সুস্থ এবং সুন্দর করে তুলবে।
১০) চুলের সমস্যার ক্ষেত্রে ও নিম পাতার ব্যবহার করা যেতে পারে। চুলকে উজ্জ্বল এবং স্বাস্থ্য সম্মত করে তোলার জন্য চুলে নিম পাতার তেল, নিম পাতার প্যাক ব্যবহার করতে পারেন।
গরমে নিম পানিতে গোসলের উপকারিতা
তীব্র গরমে সারা শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছে। কী করলে এই গরমে শরীরে আরাম মিলবে, তার পথ খুঁজছেন অনেকেই। এই সময় পানিতে নিম পাতার ব্যবহার আপনাকে স্বস্তি দিতে পারে সাথে নানা উপকারও পাবেন। যেমন-
ঘামের গন্ধ: গরম আবহাওয়ায় শরীর ঘামে। ঘামের গন্ধ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। বাইরে যাওয়ার আগে নিম পাতা দিয়ে গোসল করতে পারেন। ঘামের দুর্গন্ধ দূর করে।
দাগ ছোপ: গরমের দিনে ত্বক রুক্ষ হয়ে যায়। রোদে পুড়ে ত্বক কালো হয়ে যায়। মেচতাসহ নানা দাগ দেখা দেয়। নিম পাতার যেকোন ধরনের দাগ দূর করতে বেশ কার্যকরী। এছাড়াও ব্ল্যাকহেডসের সমস্যা থাকলে নিম পাতা ব্যবহার করে গোসল করতে পারেন। এতে ত্বকের সমস্যা দূর হবে।
এলার্জি: গরমের দিনে অ্যালার্জির সমস্যাও বেড়ে যায়। আপনার শরীরের চুলকানি দূর করতে নিম পাতা দিয়ে ফুটন্ত পানিতে গোসল করতে পারেন। নিমের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান সংক্রামক রোগ এবং ত্বকের সমস্যায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আপনি যদি এ ধরনের সমস্যায় ভোগেন তাহলে নিমপাতা ফোটানো পানি ঠান্ডা করে তা গোসলের পানির সঙ্গে মিশিয়ে নিন। এই পানি দিয়ে গোসল করুন। আশাকরি উপকার পাবেন।
খুশকি: খুশকির সমস্যা দূর করতে নিমের তুলনা নেই। খুশকির সমস্যা থাকলে কাঁচা নিম পাতা রস মাথায় লাগাতে পারেন। এছাড়াও চুলের গোড়ায় ধুলো ময়লা জমলে তা দূর করতে নিমপাতা উপকারী।
কীভাবে গোসলের ক্ষেত্রে নিম পাতার ব্যবহার করবেন?
তাজা ও পরিষ্কার নিমপাতা ভালো করে ধুয়ে নিন। এরপর পানিতে দিয়ে হালকা আঁচে নিমপাতা ফুটতে দিন। ৩ থেকে ৪ মিনিট ফোটান। জলের রঙ একটু হলদেটে হলে ও নিমের গন্ধ বের হলে তা থেকে পাতা ছেঁকে নিন। ঠান্ডা হলে বালতির পানিতে মেশান। এছাড়াও নিমপাতা সামান্য বেটে তার রস গোসলের পানিতে মিশিয়ে তাতে গোটা নিমপাতা দিয়ে দিন।
আরো জানুন সিজারের পরে খাবার তালিকা
নিমপাতার ক্ষতিকর দিকগুলি
আমরা সকলেই জানি সব জিনিসেরই কিছু ভালো গুণ এবং কিছু খারাপ গুন থেকে থাকে। তেমনি নিম পাতার ব্যবহার এর ক্ষেত্রেও আছে কিছু ক্ষতিকর দিক। পাশাপাশি আমাদের মাথায় রাখতে হবে কোন জিনিসই অতিরিক্ত ব্যবহার করা ঠিক না, যার ফলে বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই নিম পাতার ব্যবহার করার আগে অবশ্যই এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলি জেনে নিন।
১) ছোট বাচ্ছাদের ক্ষেত্রে নিম তেলের ব্যবহার কিংবা নিম তেল খাওয়া মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বমি ভাব, দুর্বলতা মস্তিষ্কের ব্যাধি দেখা দিতে পারে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
২) গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে নিম পাতার ব্যবহার সহায়ক নয়। এটি গর্ভপাতের অন্যতম কারণ হতে পারে। এছাড়াও প্রসূতি মহিলাদের ও নিমপাতা থেকে দূরে থাকা উচিত। এর ব্যবহার এড়িয়ে চলা উচিত।
৩) আপনার যদি অটো ইমিউন থাকে সে ক্ষেত্রে আপনি নিম পাতার ব্যবহার এড়িয়ে চলুন। কেননা নিম পাতার ব্যবহার আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাটিকে খুব সক্রিয় করে তোলে। যার ফলে যারা অটোইমিউন রোগের শিকার তাদের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
৪) যারা নিম্ন রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে নিম পাতার ব্যবহার করা যথাযথ নয়। এটি কেননা রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। তাই যাদের নিম্ন রক্তচাপ রয়েছে তারা নিমের ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
৫) নিম বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে। তাই যারা সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন তাদের নিম এড়িয়ে চলা উচিত।
৬) এছাড়াও কোন শল্যচিকিৎসার আগে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগে থেকে নিম পাতার ব্যবহার বন্ধ করে দিন।
৭) মনে রাখবেন আপনার প্রতিদিন দুটি নিম পাতার বেশি খাওয়া উচিত নয়। আপনি যদি বড় পরিমাণে গ্রহণ করা শুরু করেন তবে এটি ভালোর চেয়ে বেশি ক্ষতি করবে।
৮) এছাড়া নিমপাতা গ্রহণের পরে যদি বমি, ডায়েরিয়া, মাথাব্যথা সমস্যাগুলি হয় সে ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে নিম পাতার ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে।
৯) অতিরিক্তভাবে, আপনার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া উচিত যে আপনি আপনার শরীরের প্রয়োজন অনুসারে নিম পাতা একটানা কতক্ষণ খেতে পারেন। একবারে এটি খেলে আপনার শরীরের অনেক ক্ষতি হতে পারে।
১০) বেশিদিন খালি পেটে নিম পাতা খাবেন না। এটা ভালোর চেয়ে ক্ষতিই বেশি করবে।
নিমপাতা সম্পর্কে আরো জানতে পারেন
প্রাচীন যুগ থেকেই আমাদের দেশের একটি সুপরিচিত গাছ নিম। মূলত গ্রাম্য এলাকায় বড় বড় নিম গাছ দেখা যায়। তবে শহরাঞ্চলে কোন ও কোন ও বাড়িতে কিংবা রাস্তার ধারে ছোট নিম গাছ দেখা যায়। তবে শোনা যায়, নিম গাছ নাকি আবহাওয়াকে পরিশুদ্ধ করে। সে কারণে অনেক বাড়িতে নিম গাছ লাগাতে দেখা যায়। তাছাড়া ইতিমধ্যেই আমরা জেনে গিয়েছে নিম গাছের ডাল পাতা, রস, ফুল, তেল, গাছের ছাল সবকিছুই কাজে লাগে। বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে নিম পাতার ব্যবহার হয়ে থাকে। চোখের ব্যথা, কৃমি, চর্মরোগ প্রভৃতি নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও নিম পাতার রস চিকেন পক্স, হাম এবং ত্বকের বিভিন্ন রোগে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলো অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান হিসাবে কাজ করে থাকে। এছাড়া গুটি বসন্তের সমস্যা দেখা দিলেও তা কম করতে এবং পক্সের দাগ কমাতে সহায়তা করে। তাই সুস্থ থাকতে দৈনিক নিম পাতার জলে স্নান করুন এবং সুস্থ থাকুন।
আরো জানুন ডিম খেলে কি প্রেসার বাড়ে
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নিম পাতার ব্যবহার
অত্যধিক রক্তচাপের সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় উপাদান হল নিম পাতা। শরীরকে ভেতর থেকে পরিষ্কার করতে সহায়তা করে এবং রক্ত বিশুদ্ধ করতে নিম পাতার ব্যবহার করা হয়। নিয়মিত নিম পাতা খেলে রক্ত চলাচলের পথ প্রশস্ত হয় এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে তা নিয়ন্ত্রিত হয়। দৈনিক খালি পেটে এক কাপ জলে মধু মিশিয়ে এবং নিম পাতার রস মিশিয়ে খাওয়া গেলে এটি শরীরের রক্ত চলাচল কে ত্বরান্বিত করতে পারে। এছাড়া দৈনিক নিমপাতা ব্যবহার করতে পারলে শরীরে হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যে কারণে যারা হরমোনের সমস্যায় ভুগছেন তাদের অনেক সময় নিমপাতার গুণসম্পন্ন ঔষধ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে গবেষণা এখনও চলছে। নিম পাতার ব্যাবহার করার আগে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
লিভারের স্বাস্থ্যরক্ষায় নিম পাতার ব্যবহার
লিভারের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে নিম গাছের ফুল গুলি। এগুলি লিভার কার্সিনোজেনেসিসে প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব ফেলে, যার ফলে লিভারের যেকোনো ধরনের সমস্যা কিংবা জন্ডিসের সমস্যা প্রভৃতি সমস্যায় নিম পাতার ব্যবহার প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব প্রদান করে থাকে।
খুশকি নিরাময়ে নিম পাতার ব্যবহার
মাথার ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক বা তৈলাক্ত হোক না কেন, আমরা খুশকির সমস্যা অনুভব করি। এই ক্ষেত্রে নিম পাতায় অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা চুলের চিকিৎসা কার্যকর করে তোলে। এছাড়াও নিম পাতার ব্যবহার মাথার তালুর শুষ্কতা এবং চুলকানি দূর করে চুলকে সঠিক স্বাস্থ্য প্রদান করে থাকে। খুশকির চিকিৎসার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভুমিকা প্রদান করে থাকে। তাহলে জেনে নিন খুশকি নিরাময়ে কিভাবে করবেন নিম পাতার ব্যবহার করবেন-
কোলেস্টেরল কমাতে নিম পাতার ব্যবহার
সমীক্ষায় লক্ষ্য করা গিয়েছে, নিম পাতার ব্যবহার রক্তের কোলেস্টেরল হ্রাস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যারা কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে রোজ যদি নিমপাতার রস কিংবা জলে ফুটিয়ে নিম পাতার জল গ্রহণ করা সম্ভব হয় সে ক্ষেত্রে কোলেস্টেরল মাত্রা শরীরে কমতে লক্ষ্য করা যায়।